এখন পড়ছেন
হোম > অন্যান্য > বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা – কলমে – অপরাজিতা – পর্ব ৯

বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা – কলমে – অপরাজিতা – পর্ব ৯


সন্ধ্যেবেলা মেয়েকে নিয়ে প্রকাশ সীমা বেড়াতে বেরিয়েছে, বারান্দা থেকে দেখলো ইরা। পার্কে যাচ্ছে সিওর। আচ্ছা ধ্রুবদা কোথায় ? দেখলো না যখন বাড়িতেই আছে। সীমাদের বাড়িতে ছুটলো ইরা। হুম বেল বাজলো, দরজা খুললো ধ্রুব।বললো -এস, দিদিরা বাড়ি নেই।

ইরা বললো দরকার তোমার সাথে।

আমার সাথে? কি দরকার? জিজ্ঞাসা করলো ধ্রুব।

কেন বলছো না, দিদি অনিমেষের সাথে ভালো থাকবে না , বিশ্বাস করো। তুমি সব বলো।
ধ্রুব – কি বলবো ?
ইরা – তুমি দিদিকে ভালোবাসো ,
ধ্রুব -ভাগ , পাগলী।
ইরা – আচ্ছা?  দিদির দিব্যি , বলো এবার।
ধ্রুব – ইরা বাড়াবাড়ি কোরো না।
ইরা – বাড়াবাড়ি করছি? দিদিকে কেন তোমার চোখ সব সময় খোঁজে? সেদিন তুমি অমন করে তাকিয়েছিলে দিদির দিকে আমি বললাম মজা করেই। কিন্তু তারপর কালকে সকালে আমি আর মা এলাম তুমি দরজায় কাকে খুঁজছিলে? আজ আমাদের বাড়ি গিয়ে কাকে খুঁজছিলে ? পরশুদিন বারান্দায় এমন করে দিদিকে দেখছিলে কেন?বলো

ধ্রুব – তুমি ভুল ভাবছো।

ইরা – আচ্ছা? দিদির ফটো তোমার মোবাইল এ কেন? তুমি যখন আজ চার্জ দিতে বললে , আমি তোমার মোবাইল এ দেখেছি।

ধ্রুব বসে পড়লো সোফায় – ইরা প্লিজ , বাড়ি যাও। আমি একটু একা থাকতে চাই।
ইরা ধ্রুবর পাশে বসলো – দিদি অনিমেষের সাথে ভালো থাকবে না , বিশ্বাস করো। আজ বলতে গিয়েও কেন বললে না। কেন বললে না তুমি দিদিকে ভালোবাসো। আমি সব শুনেছি।

ধ্রুব – তাহলে জিজ্ঞাসা করছো কেন? নীরার মন জুড়ে শুধু অনিমেষ। আমি কোথাও নেই ইরা। কোথাও না।

ইরা – আছো- দিদি নিজেও জানে না। আচ্ছা তুমি থাকতে পারবে ?

ধ্রুব- জানিনা , শুধু জানি ওর লেখা পড়তে পারবো। তাতেই কাটিয়ে দেব।

ইরা – কার লেখা? অনিমেষ চায় না তার বৌ অমন লিখুক, তাই দিদি আর বিয়ের পর লিখবে না।
ধ্রুব -কি?

ইরা – হুম, দিদি পাগল তাতেও রাজি।

ধ্রুব – তবে কি সবই ঠিক আছে।

ইরা – না নেই, ধ্রুবদা প্লিজ, তুমি আমার দাদাভাই, বিশ্বাস কর আমি তোমাকে দাদাভাই মেনেছি, কেঁদে ফেললো ইরা। ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরলো। ধ্রুব জড়িয়ে ধরে বললো -তুই তো আমার বোন ছিলি , আর থাকবি। কিন্তু এটা সম্ভব নয়। নীরা অনিমেষকে ভালোবাসে ইরা, তাকে সরাবো কি করে। আমি যে কষ্ট পাচ্ছি। ও তো সেই কষ্ট পাবে। ইরা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো – ধ্রুব বললো ভালো থাকবি। কোনো দরকার হলে ফোন করিস। বাড়ি যা , কেউ দেখলে অন্যরকম ভাববে।

ইরা – তুমি দিদির বিয়েতে আসবে না জানি আমি। আর একবার ভাব। দিদি না লিখে থাকবে কি রে ? দিদি ওই লোকটার সাথে ভালো থাকবে না।

ধ্রুব -ঠিক আছে ভাবছি , কাল সকালে বলবো ।

ইরা- আচ্ছা আমি সকালে আসব।

নঃ আর থাকা যাবে না। ইরা সব ধরে ফেলেছে। খুব ভোর রাতে উঠে ধ্রুব চলে গেলো। যাবার আগে নীরাকে যদি একবার শেষ দেখা দেখতে পেত। ট্রেনে উঠলো। নীরার শহর ছেড়ে অনেকদূর চলে গেলো ধ্রুব। ইরা সীমাদের বাড়ি এলো জানলো ধ্রুব চলে গেছে।মুখ কালো করে বাড়ি চলে যাচ্ছিলো।

ইরার মুখ কালো হবার অন্য কারণ বের করেছিল প্রকাশ, বললো – ভাবিস না তোর দিদির বিয়েতে আসবে বলে গেছে।

দিদিকে এখানে ফেলেই চলে গেলে ? আর কিছু করার নেই। নীরাকে গিয়ে বললো ইরা।

নীরা বিছানা গোচ্ছাছিলো। একটু থেমে গেলো। বললো ওহ। মনটা হঠাৎ খুব খারাপ হয়ে গেছে নীরার। কেন কে জানে? খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে নীরার। চারপাশে কেউ নেই মনে হচ্ছে ওর। ভিড়ের মাঝেও একটা মুখ খুঁজছে নীরার মন। কিন্তু নীরার মস্তিস্ক বুঝছে কি। হয়তো বুঝছে তাই জোর করে অনিমেষকে নিয়ে ভাবতে চাইছে নীরা। প্রশ্ন হলো পারছে কি ?।

পরের দিন সকালে ট্রেন ধরলো ইরা ,নীরা। কলকাতা যাচ্ছে শাড়ী কিনতে। স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে অবিনাশদের গাড়ি। গাড়িতে অবিনাশ, ওর দিদি , জামাইবাবু। অবিনাশ ওর জামাইবাবু গাড়ি থেকে নামেনি। দিদি নেমে দাঁড়িয়েছিল। ফোনে বলে দিয়েছিলো স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। যেন ইরা আর নীরা চলে আসে। ইরার খুব খারাপ লাগলো। বোধ হয় নীরারও। মনে পড়লো  ট্রেন থেকে কিভাবে ধ্রুব ওকে খুঁজে নিয়ে এসেছিলো। ওর দিদির এককাঠির উপরে অবিনাশের জামাইবাবু। তিনি তো আবার ভি ভি আই পি। দেখতে খুব সুন্দর কিন্তু ওই টুকুই।ভদ্রতার লেশমাত্রও নেই। ইরা, নীরা গাড়ির কাছে এলো। জামাইবাবু আর অবিনাশ বসে রইলো গাড়ির ভেতরে। উঠে এস – বললো ওর দিদি। নীরাকে আর ইরাকে দেখে অবিনাশ বললো ভালো ? বাস ঐটুকুই । এই লোকটার সাথে কি করে থাকবে নীরা ? ইরা যদি এটা দেখাতে পারতো ধ্রুবকে। গাড়ি ছাড়লো। বেশ বড় গাড়ি, অসুবিধা হলো না।

অবিনাশের দিদি বললো এটা তোমার জামাইবাবু নীরা ? তিনি ঘ্যাম নিয়ে কেমন একটা ভাব করে তাকালো নীরার দিকে। ইরা যেন বাইরের লোক। এমনভাবে দেখলো ইরাকে। ওর দিদি বললো এটা ওর বোন। ব্যাস। অবিনাশ , ওর জামাইবাবু বার বার নীরাকে দেখছে আর মুখটা কেমন করছে। একটা রেস্টুরেন্টে গাড়ি দাঁড়ালো। দিদি বললো নেমে এস। নীরা ,ইরা অবিনাশ বসলো , দিদিকে জামাইবাবু ডেকে কি সব বলছে। খুশি নয়, খুব একটা। অবিনাশকেও ডাকলো ওর দিদি। বসে রইলো ইরা আর নীরা। কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে কিছু একটা নিয়ে গম্ভীর আলোচনা হচ্ছে। অসভ্য লোকজন – ইরা বললো। নীরা চুপ। এই ব্যবহারটা আশা করেনি দুজনেই।

ভেতরে এসে নিজেরাই অর্ডার দিলো। ইরা, নীরা কি খাবে একবার জিজ্ঞাসাও করলো না। কফি আর কতকগুলি খাবার, কফিই খেলো নীরা আর ইরা। নীরার মনে পড়লো সেদিনের ধ্রুবর সাথে কাটানো সেই ছোট চায়ের দোকানের কথা বার বার যেতে পারে নীরা ধ্রুবর সঙ্গে। এটা বড় রেস্ট্রুরেন্ট, অনেক সুন্দর। এখানে এলে হয়তো লোকের উঠতে ইচ্ছা করে না কিন্তু ভীষণ দমবন্ধ লাগছে নীরার। সেদিন ওই ছোট্ট দোকানেও ধ্রুব জিজ্ঞাসা করেছিল কি খাবে ? ছি ছি কি ভাবছে এইসব। অনিমেষ রয়েছে তার। না কিছুতেই ধ্রুবকে আসতে দেবেনা তার চিন্তায়। কিন্তু অনিমেষ আছে কি তার সাথে ? কাঁচের দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো নীরা।

কিছুক্ষন পর সবাই এলো। খাওয়া শেষ হলে ওর দিদি বললো – একটা কথা বলছি আজকে শাড়ী কিনতে যাওয়া হবে না। একটা অসুবিধা হয়ে গেছে। পরে একদিন দেখছি। ইরা বললো- আর তো বিয়ের দেরি নেই আবার পরে শাড়ী কিনলে ব্লাউজের তো প্রব্লেম হবে। আবার একদিন আসা। জামাইবাবু বললেন – সেটা আমরা বুঝে নেবো। আর অসুবিধা হলে আসার দরকার নেই। ইরা চুপ করে গেলো। জামাইবাবুকে দিদি বললো এই তোমার মোবাইলে ওর একটা পিকচার নাও তো। দামি ক্যামেরা , যেমন একেবারে তেমনি উঠবে। মাকে দেখাবো। ফটো তোলা হলো। আবার গাড়ি করে স্টেশনে ছেড়ে দিলো। এবারেও অবিনাশ গাড়ির বাইরে এলো না। গাড়ি ইরা নীরাকে নামিয়ে দিয়েই হুশ করে বেরিয়ে গেলো। অবিনাশ একটা কথাও বলেনি। অথচ নীরা কত কিছু ভেবেছিলো। সেটাই তো স্বাভাবিক ছিল। বড্ডো অপমানিত লাগছে নীরার।

নীরার মনে পড়লো ধ্রুবর সাথে কাটানো এক একটা মুহূর্ত। একবার জন্যই মনে হয়নি ও পর। আজ অবিনাশকে দেখতেই ভয় লাগছে নীরার। চোখের ছাউনিতে কেমন একটা বিরক্ত। ইরা দিদির মনের ভাব বুঝতে পেরেছে তাই কিছু বলেনি। চুপচাপ ট্রেনে বসে বাড়ি এলো। বাড়ি এসে জানালো কি হয়েছে। নীরা খুব কাঁদলো , কেন এমন ব্যবহার করলো ওরা ? কেন অবিনাশও? সন্ধেবেলা ফোন এলো অবিনাশের দিদি ফোন করেছে , ওরা এখানে বিয়ে দেবে না। মেয়েকে মেক আপ করে দেখানো হয়েছিল। এমন কালো মেয়েকে তারা বৌ করবে না। তাদের রাজপুত্তরের মতো ছেলে। সোমেস্বরবাবুরা এমন মেয়েকে তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছিলেন। আজ বাড়ির জামাই সব দেখে সেই ফাঁকি ধরে ফেলেছে। অবিনাশ বলেছে- এমন কালো মেয়েকে সে বিয়ে করবে না। ভাবতেই পারে না ও তার সাথে এমন একটা কালো মেয়ে ঘুরছে। এতটা কালো লাগেনি আগে। তাই বৌ করতে চেয়েছিলো। সোমেস্বরবাবু অনেক অনুরোধ করলেন। বিয়ের নেমতন্ন হয়ে গেছে , সব ঠিক এখন এমন করে বিয়ে ভেঙে দেওয়া। অবিনাশের জামাইবাবু ফোন ধরে বললো – তাদের ছেলে হচ্ছে সোনা , এই মেয়েকে যদি বিয়ে করে অবিনাশ তাহলে সেটা ”বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালার মতো দেখাবে ” আর এটা অবিনাশের কথা। ও তো কোনো দোষ করে নি, ওর ঘাড়ে কি করে আমরা একটা মিশমিশে কালো মেয়েকে চাপিয়ে দেব। ডিসটার্ব করবেন না আর আমাদের। সোমেস্বরবাবু যখন জানতে চাইলেন তাহলে পছন্দ করেছিল কেন ? ফোনের ওপর থেকে উত্তর এলো আপনারা সাজিয়ে গুছিয়ে দেখিয়েছিলেন তাই। .অনেক কথা হবার পর বিয়ে ভেঙে গেলো। নীরা দাঁড়িয়ে ছিল ওখানেই আস্তে আস্তে উপরে চলে গেলো। ইরা দিদি দিদি করে ছুটলো। অতসী দেবী মেঝেয় বসে পড়লেন। সোমেস্বরবাবু প্রকাশকে ফোন করে ডাকলেন।

ইরা বুঝতে পারছে না কি করা উচিত, ভালো হল নাকি খারাপ? ইরা তো চাইছিল বিয়ে ভেঙে যাক। কিন্তু তবুও খারাপ লাগছে। এইভাবে দিদিকে অপমান করলো ওরা। ছিঃ মানুষ ওরা। নীরার এতদিনের সাজানো স্বপ্ন, যেগুলো ও একটু একটু করে অবিনাশকে নিয়ে সাজিয়েছে সব শেষ হয়ে গেলো। বারান্দায় চুপ করে বসে আছে নীরা। শুধু চোখ দিয়ে জল পড়ছে। অবিনাশ যে এতোদিন বলতো নীরাকে ভালোবাসে, রূপ দেখে নয়। সে আজ নীরাকে ” বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা” বললো। ওকে  বাঁদরের মতো- এবার হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো নীরা। ইরা ছুটে এসে দিদিকে জড়িয়ে ধরলো।

এতক্ষনে প্রকাশ ,সীমা এসেছে। প্রকাশের ও মাথায় বাজে পড়লো। এ কি কথা। প্রকাশ ফোন করলো। সেই একই কথা। প্রকাশ অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করলো যে সেদিন সীমা সাজিয়েছিল নীরাকে। কোনো মেক আপ করেনি নীরা। নীরাকে আজ অনেকদিন ধরে দেখছে প্রকাশ।  ওদের কোথাও একটা ভুল হয়েছে। কে শোনে কার কথা। বিয়ে ভাঙলো। প্রকাশ না বুঝে এই সম্বন্ধ করার জন্য বার বার হাত জোর করে ক্ষমা চাইছে। সোমেস্বরবাবু, অতসীদেবী জানেন প্রকাশ কতটা ভালো চায় , সে কি করে জানবে এমন হবে। তাঁরা বললেন সে কথা। প্রকাশ, সীমা চলে গেলো। সারা রাত দুই বাড়ির সমস্ত লোক জেগে রইলো।

 

 

 

  আগের পর্ব   –    বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা – কলমে – অপরাজিতা – পর্ব ৮

 

 

পরের পর্ব  –   বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা – কলমে – অপরাজিতা – পর্ব ১০

 

 

 

আপনার মতামত জানান -

Top
error: Content is protected !!