ভালো আছো, ভালো থেকো – প্রাক্তনীর কলম বেয়ে যাদবপুর আন্দোলনের অজানা স্মৃতিকথা কলকাতা নদীয়া-২৪ পরগনা বিশেষ খবর রাজ্য July 10, 2018 রাহুল চক্রবর্তী, পুরুলিয়া: ঐতিহাসিক সুগত বসু মহাশয়কে অসংখ্য় ধন্য়বাদ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্য়ালয় নিয়ে যে কথা গুলো গতকাল তিনি বললেন তা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এবং একই সঙ্গে ঐতিহাসিক। আমরা যারা মফস্বল থেকে যাদবপুরে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছি, তাদের একজন হিসেবে বলতে পারি যে যাদবপুর নিয়ে আমাদের বিশ্বাস সঠিক। এটা ভাবার সাহস পাচ্ছি কারণ আমাদের পাশে ছিলেন, আছেন এবং আগামী দিনেও থাকবেন আপনার মতো মাস্টারমশায়, এই বিশ্ববিদ্য়ালয়ের অসংখ্য় শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং অসংখ্য় মানুষ। বুঝলাম আবার, আমরা যারা প্রাক্তন তারা কেন এখনো বলার চেষ্টা করি ভালো থেকো যাদবপুর। মামার হাত ধরে ভর্তি হতে গিয়ে দেখেছিলাম নাম রয়েছে, তবে ওয়েটিং লিস্টে। দ্বিতীয় কাউন্সেলিং-এ সুযোগ পেলাম। আমি সেই ভাগ্যবান যার পর সেবছর আমার বিষয়ে আর কেউ ভর্তি হতে পারেনি। যারা পায়নি তাদের আফসোসটা আজও মনে পড়ে। আমায় কিন্তু ভর্তির জন্য় ছাত্র ইউনিয়নের কোন দাদা-দিদি ধরতে হয়নি, বা এটার দরকার যে হতে পারে তখন জানতেই পারিনি। এবার থেকে প্রিয় বন্ধুর খবর পড়া আরো সহজ, আমাদের সব খবর সারাদিন হাতের মুঠোয় পেতে যোগ দিন আমাদের হোয়াটস্যাপ গ্রূপে – ক্লিক করুন এই লিঙ্কে এখন এটাও নাকি করতে হচ্ছে অনেক কলেজে – ভালো নম্বর নিয়ে পাশ করার পরেও! মনে হচ্ছে যেন এটাও কেরিয়ায় তৈরীর সঙ্গে জড়িত একটা নিয়ম। আর এটা জানলাম মাত্র গত কয়েক বছর আগে থেকে – সৌজন্যে মিডিয়া। এই নিয়ম সেদিন থাকলে হয়তো আমার মতো অনেকেই সেই সময় এই ভর্তির সুযোগ পেতোনা বলেই আজ মনে হচ্ছে। যাদবপুরে ক্লাস, মিলনদার ক্যান্টিন, ধাপিতে আড্ডা, ঢপ, পরীক্ষা সবই ছিল। সালটা ২০০৫-০৬ হবে – কলকাতা কর্পোরেশনের ভোট – ঠিক সেই সময় একবার যাদবপুরে একটা বড় মাত্রার ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল। শুরুটা অবশ্য হয়েছিল আরও কয়েক বছর আগে থাকতেই, কর্তৃপক্ষের কাছে সেদিনের দাবিগুলো ছিল ভিন্ন। ঠিক ছিল না বেঠিক তা ভাবিনি সেদিন – দেখেছিলাম আমার এক প্রিয় শিক্ষিকা আমার নিজের পরিচিত অনেক বন্ধুদের মাঝে কার্যত ঘেরাও হয়ে রয়েছেন। সেদিন কিন্তু খুব রাগ হয়েছিল বন্ধুদের উপর, কারণ সেই শিক্ষক-শিক্ষিকারাই ক্লাসে সাহস দিতেন নিজের মতো ভাবার। মহাবিদ্রোহ বা সিপাহী বিদ্রোহের কারণ প্রসঙ্গে বলতেন এনফিল্ড রাইফেলের গুলির বদলে যদি দেশলাই কাঠির কারণে এই আন্দোলন শুরু হয়ে থাকে তাহলে তার যথাযথ কারণ ও যুক্তি দুটোই দেখতে হবে। অন্যদিকে, ওপেন বুক সিস্টেম ফলো করতে সুযোগ পেতাম, ফলত সাহস এমনিতেই পেতাম এটা না বলা ঠিক নয়। আমার বন্ধুদের ফুটবল খেলে এসেই পরীক্ষার খাতা নিয়ে পরীক্ষা দিতে দেখেছি। আর আমার রাগের আরো একটা কারণ নম্বরটা ছিল একটা বিষয়। কিন্তু বুঝে ছিলাম রাগ করে লাভ নেই, তবে এটাও মনে মনে বুঝেছিলাম দু নৌকায় পা দিয়ে আন্দোলন হয় না। তাই পাশে ছিলাম আমার সেই সেদিনের বন্ধুদের। যখন ঘেরাও উঠে গেল সেই শিক্ষিকা – এক কথায় বিদ্ধস্ত অবস্থায় অথচ হাসি মুখে বেরিয়ে আসেন। ভেবেছিলাম এরপর আমাকে আমার প্রতিস্পর্ধার জবাব হয়ত পেতে হবে এবং হয়েছিলও তাই! আমাকে প্রায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলেন ইন্টারনাল দেওয়াতে – আমিও ইন্টারনাল দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্য়ালয়ের চত্ত্বর থেকে কলকাতার রাজপথে শোনা গিয়েছিল সেদিন ‘জবাব তোমায় দিতেই হবে’ বা ‘এই মাটিতে কবর দাও’ – মোটকথা যা যা শ্লোগান এই গত কয়েকদিন থেকে শুনতে পাচ্ছি বা এখন দেওয়া চলছে তার বেশির ভাগটাই সে সময়ও ছিল। তখন সদ্য় বাজারে আসা কয়েকটা নিউজ মিডিয়া করেছিল পুরো ঘটনার কভার, হালফিলে সেসব মিডিয়া হাউসের কয়েকটার নামও পাল্টে গেছে। হয়তো বা সেসব মিডিয়ার আর্কাইভ ঘাঁটলে এখনো পাওয়া যেতে পারে সেই ফ্রেমবন্দী ঘটনা। ঔপনিবেশিক ভারতের ছাত্র আন্দোলন বা ষাট-সত্তর দশকের ছাত্র আন্দোলনের যা ঐতিহাসিক গুরুত্ব তা কোনও ভাবে অস্বীকার না করেও বলতে পারি ছাত্র আন্দোলনের দাবী সবসময় এক হয় না বা হতে পারেনা। আমরা আমাদের দাবী-দাওয়াতে অটল থেকে বয়কট করেছিলাম বিশ্ববিদ্য়ালয়ের সমাবর্তন। তবে এটা বলতে পারি যাদবপুর প্রশ্ন করতে শেখায়, শিখিয়েছে এবং শেখাবেও – তা ঠিক বা ভুল হতে পারে, ভালো লাগতে পারে আবার নাও পারে। আবার সময়ের দাবীতে হয়ত সঠিক নাও লাগতে পারে, কিন্তু পরবর্তীকালে তা যুগোপযোগী হয়ে যায়। যেমন বিজেপির বর্তমান রাজ্য় সভাপতি কয়েক মাস আগেই কোন একটি ঘটনা বিষয়ে বলেছিলেন যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীরা ‘বেহায়া’! আর একদল তো দেশদ্রোহীদের আঁতুরঘর ভাবেন (তবে.সবাই না)! এই তিনি গতকাল যা বললেন ও দেখলাম তাতে বোঝা গেল ছাত্র ভর্তি নিয়ে এই বিশ্ববিদ্য়ালয়ে যে আন্দোলন চলছে সে বিষয়ে তিনি এখন খানিক সংবেদনশীল। অর্থাৎ, ধরেই নেওয়া যায় ছাত্রদের এখনকার দাবিদাওয়া তাঁর এবং তাঁর দলের ভালো লেগেছে – ‘বেহায়া’ ছাত্রছাত্রীরাই এখন যুগোপযোগী হয়ে উঠেছে। তবে এই ট্র্যাডিশন কিছু নতুন নয়। আমাদের সময় আমাদের আন্দোলনে অনেক সময় পাশে পেয়েছি অনেক সুধীজনকে। শুভাপ্রসন্ন থেকে কবীর সুমন এবং আরো অনেককে – কোথায় তাঁরা আজকে বা কেন আর আসতে পারছেনা বা আসছেন না তার কারণ সবাই জানে। আমার এক পরিচিত দাদা যে যাদবপুরের দিনরাত ‘শ্রাদ্ধ’ করে যেত – তিনি এখন তাঁর ভাইপোকে ওখানে ভর্তি করতে চান। বিগত কিছুদিন যাবৎ তিনি এই প্রবেশিকা পরীক্ষার দাবীতে ছাত্রদের আন্দোলনের পক্ষে। সুতরাং এটা বলাই বাহুল্য় যাদবপুর নিয়ে যে হুজুগে গুজব রয়েছে তার অধিকাংশই মিথ্য়ে রটনা। অনেকের ধারণা যাদবপুর মানে শুধুই মিটিং, মিছিল আর শ্লোগান, বামপন্থীদের ডেরা! সম্পূর্ণ ভুল ভাবনা! আমরা তৎকালীন বামফ্রণ্ট সরকারের নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছিলাম – FAS (Forum For Arts Student) তৈরী হয়েছিল। আমরা যারা বামপন্থী ছিলাম না তারাও কিন্তু একটা কথা বলার জায়গা পেয়েছিলাম। সমস্য়া হচ্ছে – অনেকেরই ধারণা যাদবপুর তাদের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোন নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুললে, শাসকদল ভাবে এরা আমাদের বিরোধিতা করছে আর অন্য়দিকে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দল ভেবে বসে এইতো এরা আমাদের হয়ে গেল! আর এটাই কিন্তু সমস্য়ার মূল কারণ। বিষয়টা এতো সহজ নয় – ছাত্ররা প্রশ্ন তুললেই ‘সব শেষ’ – এটা ভাবার যুক্তি কতোটা তা ভেবে দেখার দরকার। যাদবপুর অবুঝ এমন ভাবা একেবারেই অনুচিত। তবে হ্যাঁ, প্রশ্ন তোলার প্রয়োজণ। এমনিতেই আমাদের দেশের ছাত্র আন্দোলন বিশেষ মজবুত নয়। এই কথাটা বলছি কারণ যদি হতো তাহলে পঞ্চপাণ্ডবের ভেতরে কেউ একজন একলব্য যে কারণে আঙ্গুল কেটে ফেলেছিল তার বিরোধিতা করতো। আমার সেই শিক্ষিকা কিন্তু আমায় একটুও কম নম্বর দেননি। যাদবপুরে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কটা অত্যন্ত আন্তরিক – বাইরে থেকে বোঝা যায় না যে আসলে প্রশ্ন তোলার অধিকারটা তাঁরাই দিয়ে দেন। তাই ছাত্র আন্দোলনের মাত্রা অন্য় জায়গার থেকে যাদবপুরে স্বাভাবিকভাবেই অনেকটাই বেশি। আর সেই কর্পোরেশন ভোটে বামফ্রন্ট ক্ষমতা দখল করেছিল – আর সিপিএমের এক তৎকালীন হেভিওয়েট ও কলকাতার প্রথম সারির প্রতিষ্ঠিত নেতার (নামটা আর প্রকাশ্যে আনলাম না) ছেলে – আমার সহপাঠী বন্ধু ছিল আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে। সেদিন তার বাবা সেই ভোটে বামফ্রণ্টের হয়ে লড়াই করেছিল – এটাই যাদবপুর, এটাই প্রতিবাদের স্বর। তাই যাদবপুরের ছাত্রদের সিদ্ধান্ত তাদের হাতে থাকাটাই বাঞ্ছনীয় নাহলে, রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ না হয় নাই বা ঘটল। ** লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী এবং লেখাটি সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব ও ব্যক্তিগত মতামত। আপনার মতামত জানান -