এখন পড়ছেন
হোম > জাতীয় > আসছে ২০১৯ – কোন অঙ্কে অনিবার্য বিজেপির পতন? ব্যাখ্যায় দেবাংশু ভট্টাচার্য্য

আসছে ২০১৯ – কোন অঙ্কে অনিবার্য বিজেপির পতন? ব্যাখ্যায় দেবাংশু ভট্টাচার্য্য


বাংলায় ৩৫ বছরের বাম জমানায় যে বদ্ধমূল ধারণা জন্ম নিয়েছিল, আজ চার বছরের বিজেপি সরকারের ক্ষেত্রেও জাতীয় ধারণা প্রায় একই জায়গায় পৌঁছেছে। নরেন্দ্র মোদী কি অপ্রতিরোধ্য? এরূপ ধারণার জন্ম নেওয়াও খুব স্বাভাবিক। একদিকে যেমন দুর্বল বিরোধী ও অন্যদিকে মোদী বিরোধী যোগ্য মুখের অভাব এই ভাবনাকে দৃঢ়তর করেছে।

কিন্তু এই প্রশ্ন যদি আমায় করেন আমার আত্মবিশ্বাসী উত্তর অবশ্যই “না”। বিজেপি প্রতিরোধ্য – বিজেপিকে আটকানো সম্ভব। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট ছকে, ইগো বাদ দিয়েই এই লড়াই লড়তে হবে।

দেশের ৫৪৩ টি আসনের মধ্যে মসনদ দখল করতে দরকার ২৭২ টি আসন। ৮০ টি আসন সহ ভারতবর্ষের সব চাইতে বেশি সিট ক্যাপাসিটি উত্তরপ্রদেশের। এই রাজ্যে গত লোকসভায় ৭১ আসন একাই দখল করেছিল বিজেপি। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে ৪০৩ আসন বিশিষ্ট উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় বিজেপি একাই পায় ৩২৫ আসন। কিন্তু ঠিক এখানেই একটি বড় ‘ট্যুইস্ট’ আমরা মিস করে ফেলি! ৩২৫ আসন পেলেও ২০১৪ র তুলনায় ২% ভোট কম পায় বিজেপি। লোকসভার ৪১% বিধানসভায় ৩৯% এ গিয়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয় অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি ও তৃতীয় মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টির প্রায় সমান ২২% করে ভোট প্রাপ্তি ঘটে। প্রথম দল বিজেপির ৩৯% ও দ্বিতীয় দলের প্রাপ্ত ২২% এর মাঝে থেকে যাওয়া প্রায় ১৭% এর দূরত্ত্ব বিজেপির এই বিপুল জয়ের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এখন মায়াবতী (২২%), অখিলেশ (২২%) ও কংগ্রেস (১০%) যদি জোট বদ্ধ হয় তাদের মিলিত ভোট শতাংশ গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ২২+২২+১০ = ৫৪% এ! এদিকে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ৩৯%! মানে তফাৎ সেই ১৫% এর! অর্থাৎ ২০১৪ সালে প্রায় যে পরিমাণ গ্যাপ নিয়ে বিজেপি ৮০ টির মধ্যে ৭১ টিই দখল করে, সেই একই ভোট পার্থক্য জোটের পক্ষে গেলে বিজেপির জন্য যে কি মারাত্মক পরিণতি অপেক্ষা করছে তা হয়ত তারা নিজেরাও কল্পনা করতে পারছে না!

এখানে বিজেপির ভোট কমার ফ্যাক্টরকে ইগনোর করা সত্বেও এই পরিস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে। যেভাবে গত ৩ বছরে বিজেপি ২% ভোট হারিয়েছে শুধু মাত্র কেন্দ্রের অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সির জন্য, সেভাবেই যদি রাজ্যের যোগী সরকারের অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সিও ঘাড়ে চাপে তবে ৫৪% এর বেশি ভোট পাওয়া ফুলপুর ও গোরখপুরেও বিজেপির বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহ ঘটতে পারে, তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি এবং এই সংকেতকে যদি হিসাবে আনি, ৮০ টায় ৭৯ টা লোকসভা সিটও বিজেপির হাতছাড়া হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

একতরফা সংবাদমাধ্যম ও স্পন্সরড সোস্যাল মিডিয়ায় জয়ের ঢক্কা নিনাদের মাঝে বিভিন্ন রাজ্যে তাদের উল্লেখযোগ্য ভাবে ভোট কমার তথ্য কোথাও একটা চাপা পড়ে যাচ্ছে। ২০১৪ র লোকসভায় পিছিয়ে থেকেও যেমন বিজেপি ত্রিপুরার মত কিছু উত্তরপূর্ব–এর ছোট রাজ্য জিতেছে, তেমনই ১৪ সালে বিপুল ভাবে এগিয়ে থাকা বহু রাজ্যে তাদের পরাজয়ও ঘটেছে। বিপুল ভাবে ক্ষমতায় আসার সময় যে দিল্লিতে ৭ টি লোকসভার ৭ টিই বিজেপি দখল করেছিল, ঠিক এক বছর পরের বিধানসভায় ৭০ আসনের মধ্যে তারাই পায় মাত্র ৩টি, অরবিন্দ কেজিওয়ালের আপ দখল করে ৬৭ টি আসন। এখন এটাকেই লোকসভায় ট্রান্সফার করলে দাঁড়ায় ৭ এ ৭ আপ, ০ বিজেপি!

তারপরেই আসে বিহার নির্বাচন – ৪০ টি লোকসভার মধ্যে এখানে ৩১ টিতেই জয় পায় বিজেপি, কিন্তু পরের বছর হওয়া বিধানসভায় ২৪৩ এর মধ্যে প্রায় ১৮০ আসন জিতে ক্ষমতা দখল করে লালু নীতিশের মহাজোট। যেখানে লোকসভায় বিরোধিরা ৪০ এ মাত্র ৯ আসন পায়, সেই রাজ্যেই বিধানসভার হিসাবে প্রাপ্ত লোকসভার আসনসংখ্যায় তারা ২৫ এ দাঁড়িয়ে। যদিও পরবর্তীতে নীতিশ কুমার পুনরায় বিজেপি জোটে যোগ দেন।

এভাবেই লোকসভায় ভালো ফল করা পাঞ্জাবও বিধানসভা ভোটে বিজেপি অকালি জোটের থেকে ছিনিয়ে নেয় কংগ্রেস। গোয়ার বিধানসভা ভোটে মাত্র ২ বছর পূর্বের লোকসভার তুলনায় বিপুল ২২% ধ্বস নামে বিজেপির ভোটব্যাঙ্কে। বিজেপিকে দ্বিতীয় স্থানে ঠেলে দিয়ে প্রথম স্থান দখল করে কংগ্রেস, যদিও এই মারাত্মক প্রত্যাখ্যান সত্বেও ‘ঘোড়া’ কেনা বেচার সৌজন্যে সরকার গড়ে বিজেপিই! শেষমেষ এই বছরের গুজরাট বিধানসভায়, যা কিনা বর্তমানে বিজেপির দুই কিংবদন্তি নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহর গড় বলে পরিচিত, সেখানেও ১০০ র আগেই থেমে যায় বিজেপির এক্কা গাড়ি, পিছন থেকে উঠে এসে বিজেপির প্রিয় ‘পাপ্পু’ হঠাৎ করে রাহুল গান্ধী হয়ে উঠে জিগনেশ-হার্দিক দের মত তরুণদের হাত ধরে প্রায় বাজিমাত করে দেয়।

একই ভাবে উপনির্বাচনে গত লোকসভায় প্রায় ২ লক্ষাধিক ভোটে জেতা বিজেপি শাসিত রাজস্থানের দুই কেন্দ্র প্রায় দেড় লক্ষ ভোটে প্রত্যাখ্যান করে বিজেপিকে। আমরা দেখছি, বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশের নির্বাচনেও জেতা আসনে মুখ থুবড়ে পড়তে হচ্ছে অমিত শাহদের অহংকারকে। এমনকি স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের কেন্দ্রেও ভরাডুবি হয় নরেন্দ্র মোদীর দলের।

পূর্বে নতুন করে উদয় হচ্ছে বিজেপির, কিন্তু উত্তর ও পশ্চিমের হিন্দি বলয়ে গেরুয়া সূর্য আজ অস্তমিত। বিজেপির জন্য পূর্বের জয়, পশ্চিমের হারকে ব্যালেন্স করতে পারে মানসিক ভাবে, কিন্তু বাস্তবের মাটিতে তাও হচ্ছে না ! উত্তর পূর্বের যে রাজ্যে বিজেপির নতুন উদয়, সেখানে সাকুল্যে আসন ৭ টি! আর যে হিন্দি বলয়ে বিজেপির তরী ডুবন্ত, তার আসন সংখ্যা ২০০–রও বেশি! ২০০ টির বিনিময়ে ৭ টি পাওয়ার বিষয়ে উন্মাদ ছাড়া কারুর কাছেই আনন্দের বিষয়ে হতে পারে না।

হিসাব বলছে, অখিলেশ, মায়াবতীর জোট হলে, তৃণমূল সমেত বিরোধী জোট ২৫০ র বেশি আসন পেতে পারে। এখন কংগ্রেস যদি ১০০ টিও পায়, ৩৫০ আসন নিয়ে ক্ষমতায় আসতে পারে কংগ্রেস সমর্থিত ফেডারেল ফ্রন্ট। অর্থাৎ –

সিনারিও ১. কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট ।
সিনারিও ২. কংগ্রেস সমর্থিত বিরোধী জোট ।
সিনারিও ৩. কংগ্রেস ও বিজেপি বিরোধী জোট ।

তৃতীয় সিনারিওটি সোনার পাথর বাটি। নেতৃত্ব অথবা সমর্থন, কংগ্রেস ছাড়া মোদী বিরোধী সরকার গঠন হবে না। কংগ্রেস অবশ্যই চাইবে নেতৃত্ব দিতে, কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতে বিজেপিকে রুখতে তারা বিরোধী জোটকেই সমর্থন যে দেবে, তা বলা বাহুল্য।

২০১৪ সালের পর যে কটি নতুন রাজ্যে বিজেপি জয়লাভ করেছে, এক মাত্র গুজরাট বাদে তার সব কটিতেই বিজেপি ছিল বিরোধী শক্তি। অর্থ্যাৎ শাসক দলের বিরুদ্ধে থাকা অ্যান্টি ইনকাম্বেসি ‘বিরোধী’ বিজেপির জয় আরো সহজ, আরো অনায়াস করে তুলেছে। সেই হিসাবে, এবার অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সি কিন্তু বিজেপির বিরুদ্ধে জোড়া ফলা তাক করে আছে! প্রথমত কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে থাকা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়া, দ্বিতীয়ত রাজ্য গুলিতে প্রতিষ্ঠিত বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়া। এই দুটি একত্রে সামলে ওঠা বিজেপির পক্ষে খুব সুবিধার হবে কি?

সমগ্র দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে বিজেপির সাথে কংগ্রেসের মুখোমুখি লড়াই। সেক্ষেত্রে কংগ্রেসের গ্রহণ ‘অযোগ্যতা’ বিজেপির গ্রহণ যোগ্যতার চাইতেও বেশি কিছু কিছু অঞ্চলে। তা সত্বেও যদি রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশের মত হিন্দি বলয়ের উপনির্বাচনগুলিতে বিজেপিকে ক্রমাগত প্রত্যাখ্যান করে কংগ্রেসকে গ্রহণ করতে থাকে, বুঝতে হবে, বিজেপির কপালে শনিদেবতা নাচছেন! তার উপরে যদি আঞ্চলিক দলগুলির মহাজোটও কংগ্রেসের সমর্থনে বিজেপির বিরুদ্ধে ময়দানে নামে, বলার অপেক্ষা রাখে না, বিজেপির পরাজয় এক প্রকার অনিবার্য।

অর্থ্যাৎ, হ্যাঁ, বিজেপিকে হারানো সম্ভব – একশো বার সম্ভব। কিন্তু নিজস্ব ইগো ও প্রধানমন্ত্রিত্বের সুপ্ত বাসনা পাশ কাটিয়ে বিরোধীদলগুলি প্রকৃত উদ্দ্যেশ্য সাধনে কতটা কাছে আসতে পারবে, সেটাই লিখে দিতে চলেছে ভারতবর্ষের আগামী ইতিহাস।।

দেবাংশু ভট্টাচার্য্য
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক

আপনার মতামত জানান -

Top
error: Content is protected !!