এখন পড়ছেন
হোম > অন্যান্য > পরকীয়া – কলমে অপরাজিতা – ছোটগল্প

পরকীয়া – কলমে অপরাজিতা – ছোটগল্প


উফফ! এইসময় একটা সিগারেট পেলে ভালো হতো – হেব্বি টেনশন হচ্ছে! মেয়েটা কি বলবে কে জানে? এখন সবটাই তো তার হাতে! আর এদিকে এই বুড়োটা! জন্মে থেকে জ্বালিয়েছে এখনো জ্বালাচ্ছে, যতদিন বাঁচবে জ্বালাবে! ৯০ পার হয়ে গেছে – আর কি দরকার বাপু, বেঁচে থেকে হার মাস জ্বালানোর? আগে মনে হচ্ছিলো,  ৯০ হয়ে গেছে আর বেশিদিন বাঁচবে না! কিন্তু যা টাট্টু আছে, ও এখনো অনেকদিন বাঁচবে! একবার আজ এর থেকে নিষ্কৃতি পাই তারপর দেখাচ্ছি। বক্তৃতা দিচ্ছে? মাথা খারাপ করে দিলো একেবারে! না বাবা বেশি কিছু বলব না! ওকে নিয়ে যা যা খারাপ চেয়েছি সেই গুলোই আমার হয়েছে! একবার চেয়েছিলাম বুড়ো অন্ধ হয়ে যাক। কোথাও কিছু নেই আমার চোখে চশমা বসে গেলো। – এখুনি দেখবো আমিই দুম করে মরে গেলাম!

যাক বাবা, অবশেষে হাততালি পড়েছে – এইবার ব্যাটা বুড়ো নামবে। সেই থেকে ভজ ভজ করে কানের পোকা নড়িয়ে দিলো একেবারে! ঠাকুমা উঠলো – গান করছে! না সরি, বলা ভালো, গানটাকেই কবিতার মতো বলার চেষ্টা করছে! পাশে ছোট কাকিমা হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে আর বাবা তবলা বাজাচ্ছে আপন মনে – কোনো কিছুই মিলছে না যদিও। কবিতা-রূপী গান, হারমোনিয়াম, তবলা – যে যার মতো পারছে বেজে চলেছে! কারোর সাথেই কারোর কোনো মিল নেই! সবথেকে আশ্চর্য, খাবার লোভে লোকে বসে সেটা শুনছেও! আবার শেষ হলে হাততালিও দেবে। প্রত্যেক বছর দুবার করে এই একই জিনিস চলে! কিন্তু মেয়েটা আসছে না কেন? সেই তো একমাত্র পারে এই বিপদ নামক আপদ থেকে আমাকে বাঁচাতে! বুড়ো আবার এদিকে ওদিকে লক্ষ্য রাখছে। ব্যাটা, ৯০ বছর বয়সেও দূরের জিনিস স্পষ্ট দেখে। মেয়েটা এলে একটু সাইডে নিয়ে গিয়ে কথা বলতে হবে – বুড়ো দেখতে পেলে আবার কিছুতে ফাঁসিয়ে দেবে।

ওহ! এতক্ষন ভাবছেন আমি কে? আর বুড়ো কে? কি ব্যাপার? আরে, বলছি বলছি সব – কিন্তু, তার আগে বলুন, কখনো শুনেছেন যে রবীন্দ্রনাথ কাউকে ফাঁসিয়েছেন? আমাকে দিয়েছেন – সেই হয়ে থেকে, ভায়া আমার বাবার বাবা, মানে দাদু। ব্যাপারটা হলো, আমার দাদু আদ্যোপান্ত রবীন্দ্রপ্রেমী। বয়স যত বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে পাগলামি বেড়েছে – আর এখন তো তা মাত্রাছাড়া! সামনাসামনি ‘দাদু’ বললেও, এমনি সময়ে আমি বুড়োই বলি – কারণ আছে। মেয়েটা যতক্ষণ না আসে সেইটাই একটু বলছি, শুনুন।

আমার নাম মহেন্দ্র। তবে, যে সে মহেন্দ্র নয় – একেবারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের – চোখের বালির মহেন্দ্র। ছোটবেলায় বন্ধুদের অনেকে ভালো নামের পাশে, এই মহেন্দ্র নামটা বড় বেমানান লাগতো। আমার মোটেই পছন্দের ছিল না। কিন্তু বদলাবার সাহস কারো নেই, কেননা নামটা ওই বুড়ো, মানে আমার দাদুর দেওয়া। বড় হয়ে যখন চোখের বালি পড়েছিলাম, আমার মহেন্দ্রর চরিত্র একেবারেই ভালো লাগেনি! নিজের বৌ থাকতে, তাকে ঠকিয়ে অন্য কারুর সাথে প্রেম? পরকীয়া ব্যাপারটা আমার ঠিক পছন্দ হয়নি। এর থেকে বিহারীর চরিত্রটা আমার কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। দাদু পরকীয়া করেছে বলে তো কোনোদিন শুনিনি – তবুও দাদুর কি করে এই নাম পছন্দ হয়েছিল জানিনা! কেননা তিনি তাঁর কোনো কাজের কৈফিয়ত কাউকে দেননি – দেননা।

এই বাড়িতে শুধু আমার নয়, আমার বাবা, কাকা, বোন, কাকার ছেলে, পিসিদের – এমনকি, মা, কাকিমা, ঠাকুমার নাম – ওই রবি ঠাকুরের কোনো না কোনো চরিত্রের নামে। বিয়ের পর ঠাকুমার নাম চেঞ্জ করে দিয়েছিলেন ওই বুড়ো। মা-কাকিমার ক্ষেত্রে অবশ্য বিয়ের আগেই চেঞ্জ করে দিয়েছিলেন। ওই বুড়োর, থুড়ি মানে দাদুর দেওয়া নতুন নাম নিয়েই এ বাড়িতে এসেছিলেন মা-কাকিমারা।

এদিকে, ঠাকুমার কবিতা-রূপী গান আপাতত শেষ, এবার মা উঠলো। মা, যদিও গানটাকে গানের মতোই গায় – তবে তাল একটু অন্য দিক দিয়ে যায়, এই আর কি! আচ্ছা যা বলছিলাম – পিসেমশায় ও তাদের ছেলেমেয়েদের অবশ্য নামকরণ করা যায়নি। তাঁরা তাঁদের বাবা-মায়ের দেওয়া নামেই এখনো পরিচিত। তবে তাঁদেরকে দাদু একটা করে নাম দিয়েছিলেন – এ বাড়িতে অবশ্য, সেই নামেই তাঁদেরকে ডাকতে হয়। ও হ্যাঁ, আর একটা কথা – আচ্ছা আপনারা বসে বসে শুনছেন তো? কেননা বুড়োর অনেক কীর্তি আছে – সবগুলো শুনতে শুনতে পরে গিয়ে চোট লাগতে পারে কিন্তু!

যাক যেটা বলছিলাম, বুড়োর বাবা মারা যাবার পর, বুড়ো সবার নামের পাশাপাশি নিজের নামটাও এফিডেফিড করে রবীন্দ্রনাথের কোনো উপন্যাসের চরিত্রের নামে রেখেছেন। তিনি নাকি তাঁর মায়ের নামটাও বদলাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি অক্কা যাওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি! তবে ছেলে নাম বদলাবে – সেই ভয়েই তিনি অক্কা পেয়েছিলেন কিনা ঠিক জানা নেই!

আমি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি, আমাদের বাড়িতে ২৫ শে বৈশাখ – রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন, আর ২২ শে শ্রাবন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন – বেশ গুরুগম্ভীর ভাবে পালিত হয়। ঠাকুমার কাছে শুনেছি – আগে বাড়িতেই ছোট করে এই দুই অনুষ্ঠান হত। রবীন্দ্রনাথের ফটোতে মালা দিয়ে, সকালে স্নান সেরে, একটু গান-আবৃত্তি হত। বাড়ির সকলে মিলেই করতো এই সব। ব্যাস – তারপর আস্তে আস্তে দাদুর পাগলামি বাড়তে থাকলো। পাড়ার লোককে বলা হতে শুরু হলো। তাঁদের মধ্যে যাঁরা – গান, আবৃত্তি, নাচ জানেন – তাঁদেরকে সাদর সম্ভাষণে আসতে বলা শুরু হলো। আমি অবশ্য ছোটবেলা থেকে সেইটাই দেখে আসছি। তাঁদের জন্য লুচি, কুমড়োর তরকারি আর মিষ্টির ব্যবস্থা থাকতো। যদিও রবীন্দ্রনাথ – এইসব লুচি-তরকারি ভালোবাসতেন কিনা জানিনা, দাদু ভালোবাসেন – তাই এই ব্যবস্থা!

এরপর, আমি যখন কলেজে পড়তে গেলাম, শুনলাম সে বছর নাকি বিশাল ধুমধাম হবে। দাদুর ইচ্ছা, রীতিমতো বাইরে প্যান্ডেল করে স্টেজ বানাবেন – সেখানে গান, নাচ, কবিতা পাঠ, আবৃত্তি করা হবে। আর সেবারে নাকি দুপুরেও খাওয়ানো হবে – তবে সেটা যাঁরা পার্টিসিপেট করবেন, তাঁরা আর তাঁদের বাড়ির লোকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য! মেনু হবে – ভাত, ডাল, আলুভাজা, কুমড়োর তরকারি, মাছ, দই – বাকিদের শুধুমাত্র মিষ্টি দেওয়া হবে। সেই থেকেই চলছে। ২২ শে শ্রাবনেও মেনুটা একই থাকে। তবে যেহেতু – গুরুদেবের মহাপ্রয়াণের দিন, একটা দুঃখের ব্যাপার – তাই, সেইদিন মাছটা বাদ।

পারফরম্যান্স হয়ে গেলে, লোকজনকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য আমরা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি, এখনো তাই আছি। তবে, এবছর আমার এখনো পারফরম্যান্স হয় নি – দেরি আছে। সবে মায়ের গান হলো – তার সঙ্গে একটু ডায়লগও দেওয়া হলো। সেটা এমন – ক্ষমা করবেন, একটু ভুল হয়ে গেলো, আসলে অনেকদিন তো গাইনা! এদিকে এক মাস আগে থেকে রীতিমত প্রত্যেকদিন নিয়ম করে রিহার্সালে বসে বাড়িতে! পাড়ার লোকেও সেটা শুনতে পায়। তবুও মা প্রত্যেক বছর নিয়ম করে বিগলিত হয়ে এই কথা বলে, আর পাড়ার লোকেরাও গদগদ ভাবে প্রত্যুত্তর দেয় – না না, ঠিক আছে! কত সুন্দর গাইলে!

দাদুর অবশ্য এতে বিশেষ কিছু প্রবলেম নেই, ভালোবেসে মন থেকে গাইতে হবে। সুর মোটামুটি ঠিক থাকলেই হবে – সবথেকে বড় কথা কোনো ‘কায়দা’ চলবে না। সেবার ছোট পিসির ছেলে গিটার নিয়ে এলো, সে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে উঠল – বড় বেশি আধুনিক স্টাইলে! দু-কলি শুনেই ধমকে থামিয়ে দিলেন দাদু। ছোটপিসে ছেলের হয়ে বলার চেষ্টা করেছিলেন – বাবা এখন এমন করেই লোকে গাইছে। আপনি যেটা শোনেন, ব্যাকডেটেড! দাদু, ঠাকুর ঘরে গিয়ে গঙ্গা জল এনে, সেটা স্টেজে ছিটিয়ে শান্ত গলায় বলেছিলেন – সন্তানদের মধ্যেই বাবা মায়ের গুন থাকে, তোমার ছেলেও তাই পেয়েছে! এবার বুঝলাম নলিনাক্ষ কেন এমন আহাম্মক হয়েছে!

ছোট পিসির ছেলের একটি আধুনিক নাম থাকলেও, দাদু তাকে ওই ‘নৌকাডুবির নায়কের’ নামেই এ বাড়িতে ডেকে থাকেন! নিজের শ্বশুরের কাছে সর্বসমক্ষে এইভাবে অপমানিত হয়ে – আর এক মিনিটও দাঁড়াননি ছোটপিসে। ছোটপিসি আর নিজের ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, তৎক্ষণাৎ! তাতে দাদুর অবশ্য কোনো পরিবর্তন হয় নি, যেমন গঙ্গা জল ছিটাচ্ছিলেন, গোটা বাড়িতে ছেটাতে লাগলেন। সেই ঘটনার পর, আজ পর্যন্ত এই বাড়িতে আর আসেননি ছোটপিসে বা তাঁর ছেলে। তারপর থেকে বাপের বাড়িতে একাই আসেন ছোটপিসি।

যাইহোক, এবার স্টেজে উঠলেন আমার কাকিমা। তিনি নাচ আর গান – দুইই করেন। তারপর বোন – সেও নাচ-গান দুই করবে। কাকার ছেলে করবে – গান আর আবৃত্তি। তারপর বাবা-কাকা – এক এক করে আবৃত্তি করবেন। তারপর ডাক পড়বে আমার। তারপর পাড়ার ছেলেমেয়েরা – তারা ভুলভাল গাইলেও অসুবিধা নেই! দাদুর কথা হলো, বাচ্ছা তো! তাদের মায়েরাও সব – কার ছেলে মেয়ে কত ভালো পারফরম্যান্স করতে পারে, তার প্রতিযোগিতায় নামেন!

তবে আমার প্রবলেম একটাই – আমার এসব বাড়াবাড়ি কোনোকালেই পছন্দ নয়। ফলে আমাকে বাদ দিলেই মিটে যায়! কিন্তু, তা হবে না! যে বারে চাকরি পেলাম, বললাম – আমি থাকতে পারবোনা, ছুটি নেই। আমাকে দাদু জানালো – অমন চাকরির দরকার নেই! যাঁরা কবিগুরুকে মান দিতে জানেন না – ছেড়ে দাও তাঁদের চাকরবৃত্তি! আমি এমবিএ করে একটা বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি করি – তারা কি করে বুঝবে এসব? সে কথা বলতেই, দাদু নিরুত্তাপ গলায় বললো – তাহলে আর বাড়ি ঢুকো না! একপ্রকার বাধ্য হয়ে ছুটি নিতে হলো, কেননা সেটা না করলে সত্যিই আর আমার জন্য বুড়োর বাড়ির দরজা খুলত না!

আমাদের বাড়িতে ছোট থেকেই দেখছি ঠাকুরঘরে একখানা রবীন্দ্রনাথের ফটো আছে। তাঁকে অন্য ঠাকুরের মতো, নিত্য পুজো করা হয়। বাড়িতে সত্যনারায়ণ, এমনকি লক্ষী পুজো হলেও আগে রবীন্দ্রনাথকে ফুল বেলপাতা দিয়ে দাদু পুজো করেন – তার পর বাকি পুজো। দাদু আবার রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মন্ত্রও লিখেছেন। খানিকটা গায়েত্রীমন্ত্র স্টাইলে –
“ওম, রবীন্দ্রনাথায় বিদ্মহে, ভানুসিংহায় ধীমহি
তন্ন রবি প্রচোদয়াৎ, ওম রবীন্দ্রনাথও নমো।”
পুরোহিতমশায়কেও নিত্যপুজোতে এই মন্ত্র বলে দুটো ফুল ছুঁড়ে দিতে হয় রবি ঠাকুরের ফটোতে।

দাদু ব্যাপারটা নিয়ে কিন্তু বিশাল সিরিয়াস। প্রতিদিন সকালে স্নান সেরে ঠাকুরঘরে ঢুকে মন্ত্র বলে পুজো করে, তারপর দরকারি কথা বলেন। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও তিনি মুখ খুলবেন না।

আমি একবার আপত্তি করেছিলাম। আমার যুক্তি ছিল, রবীন্দ্রনাথ নিজে ব্রাম্ভ ছিলেন, তাঁকে এইভাবে পুজো করলে তিনি তো রাগ করবেন! আমাকে দাদু – শান্ত অথচ টিপ্পনি কাটা গলায় উত্তর দিয়েছিলেন, তোমার যে দিন দিন উন্নতি হচ্ছে তাতে আমি খুশি।মানুষ হচ্ছ আস্তে আস্তে। রবীন্দ্রনাথ আমার দেবতা, আমি তাঁকে দেবতা জ্ঞানেই পুজো করি। তিনি ব্রাম্ভ হলেও, সব ধর্মকে মানতেন, শ্রদ্ধা করতেন। তুমি কি করে জানবে এসব? আহম্মক!

খুব রাগ হলেও আমি আর কিছু বলিনি। দাদুর বরাবরই আমার উপরে খুব রাগ। কেননা আমাকে তিনি গান শেখাতে চেয়েছিলেন। গানের অনেকগুলো মাস্টারমশাই এসেছিলেন। কিন্তু আমাকে গান করানো তো দূর, গলাই বসাতে পারেননি। কিন্তু হাল ছাড়েননি দাদু। অনেক বেসুরোকে সুরের সাগরে ভেড়ানোতে সিদ্ধহস্ত ও পাড়ার গানের মাস্টারমশাই, শ্যামবাবুকে ধরে এনেছিলেন শেষপর্যন্ত। তাতেও অবশ্য সুবিধা হয় নি! দুদিন যেতেই বুঝেছিলাম, শ্যামবাবু একটু পেটুক টাইপের মানুষ ছিলেন, তিনি খেতে পেলেই খুশি। ছাত্র সুরের ডিঙায় না চাপলেও, খুব একটা চাপাচাপি করতেন না!

তাতে আমি মনে মনে একটু খুশি থাকলেও, বুড়োর ভয়ঙ্কর আপত্তি ছিল! ব্যাপারটা বুঝলাম এক সপ্তাহ পেরোতেই! একদিন আমি বেসুরো-বেতালা হয়ে হারমোনিয়ামে প্যাঁ-পোঁ করছি আর আর শ্যামবাবু সবে মুখে গরম সিঙ্গারাটা পুড়তে যাবেন – এমন সময়, লাঠির হাতল করে তাঁর হাতটা ধরে দাদু বললেন, শ্যাম – আমি দেখছি তোমার গান শেখানোর থেকে খাওয়াতে বেশি মন। আমার আবার খাওয়ানোর থেকে গানে বেশি মন। দেরি করেননি শ্যামবাবু, মাথা নিচু করে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। দাদুর অপমান করাটা ভালো না লাগলেও, আর গান শিখতে হবে না বলে একটা স্বস্তি মিলেছিল! কিন্তু হাল ছাড়ল না বুড়ো – অনেক করেও যখন গান একেবারেই হলো না, আবৃত্তি নিয়ে আমার পিছনে পড়ল! আমাকে এখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবৃত্তি করতে হয়।

আর আমিই এ বাড়িতে একমাত্র, যে একটু-আধটু দাদুর এইসব পাগলামির প্রতিবাদ করার সাহস করি, যদিও লাভ কিছুই হয় না। শান্ত নির্লিপ্ত গলায় বলেন – শুনেছি, অনেকে ঘর ভাড়া দেয় অল্প টাকাতে। সেক্ষেত্রে খাবার ভালো হয়না অবশ্য। তাতে কি? নিজের মতো বেশ থাকা যায়, চেষ্টা করে দেখতে পারো! মানে, বুড়োর কথা না শুনলে, ঘুরিয়ে ‘বেরিয়ে যাও’-এর ফরমান! চলেই যেতাম, শুধু বুড়ো বাদে বাড়ির বাকি সবাইকে বড্ডো ভালোবাসি, তাই যেতে পারি নি।

আমাদের নতুন ফেসবুক পেজ (Bloggers Park) লাইক ও ফলো করুন – ক্লিক করুন এখানে

আমাদের টেলিগ্রাম গ্রূপে জয়েন করতে – ক্লিক করুন এখানে

আমাদের সিগন্যাল গ্রূপে জয়েন করতে – ক্লিক করুন এখানে



আপনার মতামত জানান -

আচ্ছা প্রথমেই বলেছিলাম – রবীন্দ্রনাথ আমাকে ফাঁসিয়েছেন – মনে আছে? এবার আসি সেই ‘ফাঁসানোর’ কথায়। এই বাড়িতে প্রেম নিষিদ্ধ – আমার অবশ্য প্রেমের বালাইও নেই। সারাদিন বুড়োকে কি করে শায়েস্তা করবো, সেই নিয়েই ভাবি। কিন্তু গতকাল রাত্রে আমার মাথায় বাজ ফেলেছে ওই বুড়ো। ডাক্তার অজিতের ভাগ্নি, খুব ভালো রবীন্দ্র সঙ্গীত গায়, রবীন্দ্রভারতী ইউনিভার্সিটি থেকে মিউজিকে মাস্টার করেছে – একেবারে ফার্স্ট ক্লাস, ফার্স্ট। তার সাথে নাকি আমার বিয়ে ঠিক করেছে বুড়ো। আজ সে আসবে, গান করবে। আর পাকা কথা, আশীর্বাদও হবে আজকেই।

আমাদের বাড়ির বৌ হওয়ায় একমাত্র যোগ্যতা লাগে – রবীন্দ্রসংগীত গাইতে, রবীন্দ্রনৃত্য বা রবীন্দ্রাবৃত্তি করতে পারা! তবে, নাচ বা আবৃত্তি হলেও ভালো, না হলেও অসুবিধা নেই – কিন্তু গান গাইতেই হবে, মাস্ট। কালো, ফর্সা, মোটা, রোগা, লম্বা, বেঁটে – এসব কিছু ম্যাটার করে না, ম্যাটার করে শুধু রবীন্দ্রনাথের গান! মা একটু আধটু গাইতে পারতো, অবশ্য সেই তুলনায় কাকিমা ভালো গায়। জামাইদের একটু আধটু কবিতা জানতে হবে – তা জানে পিসেরা। আর সেই সব গুণাবলীর জেরেই বাবা-কাকা-পিসিদের বিয়ের পর্ব মিটেছে! আর এবার আমার বিয়ের মাঝেও রবীন্দ্রনাথ ‘নাক’ গলাচ্ছেন – ‘ভায়া’ ওই বুড়ো!

বিয়ের কথা উঠতেই, লাভ হবে না জেনেও আমি তীব্র আপত্তি করলাম। কেননা কাকুর কাউকে একটা পছন্দ ছিল, কিন্তু সে গান জানতো না। দাদু নাকি সিধে না করে দিয়েছিলেন। কাকু দাদুকে ভয় দেখিয়েছিলেন, হাতের শিরা কেটে মরবেন! নাহ, তাতেও নাকি বুড়োর মনে কোনো প্রভাব পড়েনি! ভাবলেশ মুখে জানিয়েছিলেন – বড় হয়েছো, যা ভালো বোঝো করো। তবে এটা ঠাকুরের বাড়ি – পবিত্র স্থান, এখানে ঠাকুর বিরাজ করেন। ওসব রক্ত-টক্ত ফেলে, এ বাড়ি অপবিত্র করো না। বাড়ির বাইরে গিয়ে যা খুশি করো। এরপর আর নিজের ‘প্রেম’ বাঁচাতে, কাকুর মরার সাহস হয়নি। নিজের বাবার পছন্দ করা, রবীন্দ্রসঙ্গীত জানা মেয়েকেই বিয়ে করতে হয়েছিল, ‘জেহাদ’ ছেড়ে!

ফলে, আমার ক্ষেত্রেও যে এসব কাজ করবে না, জানতাম। কিন্তু অসম্ভব! দরকার হলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। তবু বিয়ে করবো না এই মেয়েকে। না, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতা নেই। কিন্তু আর শুধুমাত্র রবীন্দ্রসঙ্গীতের শর্তে আমি বিয়ে করতে রাজি নই! তাছাড়া আমি হিন্দি, ইংরেজি বা বাংলা আধুনিক সিনেমার গান শুনতে বেশি ভালোবাসি। ব্যক্তিগতভাবে আমার একটু স্মার্ট মেয়ে পছন্দ, যারা অক্লেশে আমার কর্পোরেট লাইফের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে। অবশ্য বলছি না যে, রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় মানেই – আনস্মার্ট।

কিন্তু দাদুর পছন্দ আমি দেখেছি তো, তাই বললাম। আমার মা-কাকিমা আনস্মার্ট খুব একটা নয়, কিন্তু দাদুর ভয়ে কাঁটা! আমার চায় জেদি, যে পাল্লা দিয়ে বুড়োর সাথে লড়তে পারবে। চাকরি করা মেয়ে হলে আরো ভালো – আরো সাবলম্বী, বুড়োকে আরও বেশি ‘যুদ্ধং দেহি’ মনোভাব দেখাতে পারবে! উনি যেমন ‘পুতুল পুতুল’ বাড়ির বউ চান – আমি তার ঘোর বিরোধী! আর তাই, বিয়ের কথা উঠতেই, তীব্র প্রতিবাদ করে বললাম এ বিয়ে আমি করবো না। বলে দিলাম – দরকার হলে আজকে এখুনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবো। তবু বিয়ে করবো না। তোমার এত পছন্দ হলে তুমি বিয়ে করো।

বুড়ো বললেন – আমি এই বয়সে বিয়ে করলে তোমার বাবা, কাকা, ঠাকুমা বা পিসিরা খুশি হবে না। অমন মেয়েকে হাতছাড়া করতে চাইনা বলেই তোমার মতো আহাম্মকের সাথে বিয়ে দিচ্ছি। উপায় থাকলে আমিই করতাম বিয়ে। তাছাড়া, তুমিই ডাক্তার অজিতকে এ বাড়িতে এনেছিলে, আমি চিনতাম না। তাহলে, এখন আপত্তির কারণ কি?

আমি বললাম – আছে, আমি বিয়ে করবো না। কিছুতেই না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে সত্যিই চলে যাবো।

আচ্ছা ঠিক আছে। শুনলাম দেখি কি করা যায়। বলে একটু ভেবে ঠাকুমাকে বললেন – আচ্ছা শোনো কালকের জন্য যা যা দরকার এখুনি আলমারি থেকে বের করে নাও। দাদু যা বলে – ঠাকুমা তার পরিপ্রেক্ষিতে কোনোদিনই, কেন? কি? কিছুই জিজ্ঞাসা করেন না। আজকেও করলেন না। আমি ভাবলাম – যাক কাজ হয়েছে, ফাঁড়া কাটলো।

ডাক্তার অজিত একজন সাইক্রিয়াটিস্ট। বুড়োর পাগলামি দেখে, আমি ওনার সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। বুড়ো জানলে আমাকে কেটেই ফেলবে। তাই, মিথ্যা করে বলেছিলাম ইনি রবীন্দ্র-প্রেমী, দাদুর সাথে দেখা করতে চান। কিন্তু – ওই কথাতে আছে না – অভাগা যেদিকে যায়, সাগর শুকায়ে যায়! দাদুকে ঠিক করতে গিয়ে, ভদ্রলোক নিজেই বেঠিক হয়ে গেছেন। দাদু তাঁকে নিজের মতো করে নিয়েছেন। এই নিয়ে আমি বলতে গিয়েছিলাম ডাক্তার অজিতকে। তিনি অবলীলায় বলেছিলেন – চিকিৎসা তোমার দাদুর নয়, তোমার দরকার। যারা রবীন্দ্রনাথকে পছন্দ করে না তারাই অসুস্থ, যেমন তুমি। ভাবুন দেখি একবার আমার অবস্থাটা – লোকে নিজের পায়ে কুড়ুল মারে, আর আমি নিজের পাটাই সোজা কুড়ুলে মেরেছি!

যাক যেটা বলছিলাম – গতকাল রাত্রে খাওয়া দাওয়া হলে – আমাকে দাদু ডাকলেন ঘরে। ঠাকুমা শুয়ে পড়েছেন ততক্ষনে। দাদু বললেন – ওই বালিশের নিচে আলমারির চাবি আছে – চাবিটা নাও, খোলো আলমারিটা। এবার লকারটা খুলে লকারে কি আছে বের করে দেখ, ফের রেখে দাও।  লকারে তেমন কিছুই নেই – কয়েকটা ব্যাঙ্কের পাস বই, আর কিছু কাগজ। বুড়োর কথা মত সেগুলো বের করলাম, দেখলাম আবার রেখেও দিলাম! চাবি দিতে গেলাম, দাদু বললেন দরকার নেই, টেবিলে রেখে দাও। যাও ঘরে গিয়ে শুয়ে পরো। খুব রাগ হল – এই কাজের জন্য এত রাত্রে ডেকে আনার কি মানে? মাথাটা বুড়োর সত্যিই গেছে!

একে বিয়ের কথা, তার উপরে রাত-দুপুরে এইসব উদ্ভট আদিখ্যেতা – মাথাটা বেশ গরম! নিজের মনেই গজগজ করতে করতে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াচ্ছিলাম – হঠাৎ পিছন থেকে ডাক এলো। আচ্ছা শোনো, তুমি তখন কিছু একটা বলছিলে, তো আমি বলেছিলাম, ভেবে দেখছি। তা, আমি এতক্ষন ভেবে ঠিক করলাম, কালকে পাকা কথার সাথে সাথে, আশির্বাদটাও সেরে ফেলবো। কালকে আমার ঠাকুরের জন্মদিন। এর থেকে ভালো আর শুভ দিন আর কিছু নেই।

আমি চমকে বলেছিলাম – মানে? আমি আর এক মুহূর্ত থাকবো না এ বাড়িতে। তুমি শোধরাবে না।
স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে উত্তর এসেছিলো – টাকা চুরি করে পালালে কি হয় জানো?
আমি – টাকা চুরি মানে? কিসের চুরি? কার চুরি? কে করেছে চুরি?
বুড়ো শান্ত গলায় উত্তর দিয়েছিলো – তুমি আলমারি থেকে ১ লক্ষ টাকা চুরি করে বাড়ি থেকে পালিয়েছো, কাল সকালেই পুলিশে খবর যাবে। তারপর তারা আর তুমি বুঝবে।

আচ্ছা ব্যাটা, তাহলে আমি যেটা এতক্ষন বুড়োর পাগলামি ভাবছিলাম, সেটা আসলে ছিল বুড়োর শয়তানি! আমার ফিঙ্গার প্রিন্ট নেবে বলেই, সন্ধ্যে থেকে ভেবে ভেবে এত কান্ড করলো বুড়ো! মনে হয়েছিল খুনই করে ফেলি, কিন্তু সাহসে কুলায়নি!

আজ ২৫ শে বৈশাখ। আলমারি কিন্তু এখনো বন্ধ হয়নি, খোলা আছে। আলমারির বদলে বুড়ো ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে পাঞ্জাবির পকেটে চাবি নিয়ে ঘুরছেন। আর আমি এখানে সেই মেয়ের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। তাকে অনুরোধ করবো সে যেন আমাকে বিয়ে না করে।এই গেলো আমার গল্প। আমি এখনো দাঁড়িয়ে ওদিকে আমার বোন গান শুরু করবে। আমি ওদিকেই দেখছি।

পিছন থেকে মিষ্টি গলায় একটা আওয়াজ এলো – এই যে ?

আমি ঘুরে তাকাতেই দেখলাম একটি মেয়ে, দেখতে সুন্দরী বটে, তবে তার থেকেও স্মার্ট। লাল পেড়ে সাদা শাড়ী পরে আছে। আমি ঘুরতেই আমার হাতে তার হাতে থাকা তানপুরা আর ব্যাগটা ধরিয়ে দিলো ।

আমি কোনো প্রতিবাদ না করে ধরলামও।

সে এখন শাড়ীর কুঁচি, চুল ঠিক করছে। আমার হাতে থাকা ব্যাগ থেকে একটা ছোট আয়না, আর লিপস্টিক নিয়ে একবার ঠোঁটে বুলিয়ে নিলো। মুখটা ভালো করে দেখছে। এবার বাগে সেগুলো রেখে বললো আমি এতটাও সুন্দর নয় যে আমার মুখের দিকে এইভাবে হা করে তাকিয়ে থাকতে হবে।

আমি মাথা নিচু করে বললাম – না আমি দেখিনি।

সে বললো – আমি চোখে দেখতে পাই, তুমি কি আমার জন্য অনেকেক্ষন অপেক্ষা করছিলে ?

একেবারে তুমি, অবাক হলেও এই নিয়ে আমি কিছু না বলে বললাম – হ্যাঁ ,মানে না। হ্যা টা আস্তে বললেও না, টা জোর দিয়ে বললাম। আপনার জন্য অপেক্ষা করবো কেন? আমি লোকজনকে অভ্যার্থনা জানাচ্ছি এখানে দাঁড়িয়ে।

সে বললো – যাই হোক, সরি আমার আসতে একটু দেরি হলো।  আসলে পার্লারে বড্ডো ভিড়,  মেক আপ করতে দেরি হলো ,বললাম কারণ আমি একটু সাজগোজ করতে ভালোবাসি, কোথাও বের হতে গেলে আমার ১ ঘন্টা সময় লাগে সাজগোছের জন্য। ভবিষ্যতের জন্য ইনফর্মেশনটা দিয়ে রাখলাম।চলো।

আমি – চলো মানে ?

সে বললো –  মানে ভেতরে চলো, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে বাড়ি ফিরে যাবো নাকি ? আশ্চর্য !

আমি – না মানে আমার কথা আছে।

সে বললো – জানি কি বলবে, আমি খুব সুন্দরী, স্মার্ট, আমাকে দেখে তুমি প্রেমে পরে গেছ

আমি অত্যান্ত জোরের সাথে মাথা নেড়ে বললাম – না ,

সে রেগে আমার দিকে এগিয়ে এসে চোখ পাকিয়ে বললো – না, না মানে? আমি সুন্দরী নয়, আমি স্মার্ট নয়

আমি বেচারা ক্যাবলা ভ্যাবলা টাইপের, সর্বদা বুড়োকে কি করে টাইট দেব সে চিন্তা করেছি। এমন মেয়েদের থেকে দূরে থেকেছি আজ নেহাতই … আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম – না মানে হ্যাঁ। আপনি কি অজিতবাবুর ভাগ্নি?

সে বললো – হুম সম্পর্ক তাই বলছে

আমি বললাম – নামটা জানি না , তাই…………….

সে বললো – বিনোদিনী

আমি চমকে বললাম – নামকরণও হয়ে গেলো।

সে বললো – হুম সেই জন্মের পরেই , তোমার বুঝি এখনো হয়নি , তো কি নাম ডাকে লোকজন তোমাকে – বুড়ো খোকা?

আমার নাম মহে…….. বলে চুপ করে গেলাম।

সে বললো – জানি।  মহেন্দ্র।এই যে শোনো – তুমি মহেন্দ্র আর আমি বিনোদিনী। কিন্তু ‘চোখের বালির ‘ মতো কোনো পরকীয়ার কথা ভাবলেই আচ্ছা করে পেটাবো। আমার সঙ্গে ওসব পরকীয়া চলবে না। বিয়ে করে যা করার তা হবে।

আমি বললাম – মানে আপনি রাজি ?

সে বললো – হ্যাঁ, ভেবে দেখলাম ভ্যাবলা, কাব্ল্যা ছেলেকেই বিয়ে করা ভালো তাতে লাভ বেশি, আমার মতো আমি থাকতে পারবো।

আমি বললাম – মানে আমি ভ্যাবলা, কাব্ল্যা ?

সে বললো – নয়?

আমি বললাম- না, মানে হ্যাঁ , মানে না, আমি ভালো ছেলে, তার মানেই ভ্যাবলা, কাব্ল্যা নয়।

সে বললো – দেখেই বোঝা যাচ্ছে ? তা শুনলাম আমাকে নাকি বিয়ের জন্য না বলা হয়েছিল? কেন? হঠাৎ আমার দিকে ঘুরে আমার পাঞ্জাবিটা খিমচে ধরে বললো- আমি কি এতই খারাপ ?

আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম – কি করছেন? ছাড়ুন, লোকে দেখছে ?

সে বললো – দেখুক এটা আমার সারা জীবনের ব্যাপার, আর দাদুভাই বলেছে আমি ইচ্ছা হলে তোমাকে পেটাতেও পারি, ফুল সাপোর্ট আছে। এবার বলো আমি কি এতই খারাপ ?

না এতটা খারাপ লাগেনি, সত্যি বলতে ভালোই লেগেছে। তবু মুখে বললাম – এত ভাবিনি।

সে বললো – ওই জন্যই তো বললাম ভ্যাবলা, কাব্ল্যা। অন্য লোক হলে ঘুরিয়ে জড়িয়ে ধরতো।

আমি বললাম – এখানে , রাস্তায়, আমি ভালো ছেলে। আপনি আমাকে চেনেন না বলে বলছেন।

সে বললো – বেশ চিনি। আর আপনি আপনি কি? বেশি বেশি!

আমি বললাম – সম্মান দিচ্ছি , আমি ভদ্র।

সে বললো – তার মানে আমি যেহেতু তুমি করে বলছি তাই আমি অভদ্র।

আমি হতবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললাম – একথা কখন বললাম ?

সে বললো – ঘুরিয়ে বলেছো, তুমি এইভাবে আমাকে অপমান করলে? আজকের দিনে ছিঃ

আচ্ছা? আমি কি সত্যি তাই বললাম, মাথা খাটানোর সময় নেই। বললাম –  সরি, কেন সরি বলছি তও জানি না , কিন্তু মনে হলো ব্যাপারটা মিটিয়ে নেওয়াই ভালো

সে  হেসে বললো – গুড বয়, এবার বলো কি বলবে বলছিলে ?

আশ্চর্য ১ সেকেন্ডের মধ্যে আবার আগের মতো, আমি এদিকে কি বলছিলাম, কি বলার ছিল সব ভুলে গেছি. মনে করতে পারলাম না। সেই মনে করিয়ে দিলো।

সে বললো -হুম,আমি তোমাকে চিনি, ভালোমতো চিনি।  কদিন ধরে ফলো করেছি, যার সাথে ঘর বাঁধতে যাচ্ছি তাকে একটু বুঝে শুনে নিতে হবে না ।

আমাকে ফলো করেছে ? আর আমি বুঝতেও পারিনি। এ তো মেরে মাটি চাপা দিয়ে দিতে পারে , কথাটা মনে আসার পর ভয় হলেও সেই ভয়কে ছাপিয়ে আর একটা কথা মনে হলো তা হলো – মরুকগে এমন সুন্দরীর হাতে মরাটাও সৌভাগ্যের।

আমি বললাম  – বলছি নামটা কে দিয়েছিলো ?

সে বললো – দাদু, বাবার বাবা

আর একটা দাদু? একটু আমতা আমতা করে বললাম –  তিনি কি বেঁচে আছেন ?

সে বললো – না। সাথেই বললো -আচ্ছা এবার কি যাওয়া যাবে ভেতরে?

আমি হাটছি তার সাথে। বাধ্য ছেলের মতো। আশ্চর্য এতক্ষন তাকে বিয়ে করবো না বলে মাথা খারাপ করছিলাম। মস্তিস্ক অবশ্য বলছে ভেবে দেখো, এখনো সময় আছে। মন বলছে চুপ কর ব্যাটা, যা হচ্ছে হোক।

সে হঠাৎ ফের থেমে বললো – আচ্ছা কটা কথা ক্লিয়ার করে নিই। আমি শুধু রবীন্দ্র সঙ্গীত গাই না, সাথেই অন্য গানও গাই , জায়গা বিশেষে। আচ্ছা সিগারেট আর ভদকা,বিয়ার এইসব খাওয়া হয়?

আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললো  – আমি খাই, মাঝে সাঝে ,একটু আধটু। আমি হা করে তাকিয়ে দেখছিলাম। সে আমাকে মাপতে মাপতে বললো – দাদু ঠিকই বলেছিলো – আমাকেই মানুষ করতে হবে, বড্ড ক্যাবলা।

এদিকেই বুড়ো আসছে। বুড়োকে দেখে বিনোদিনী একটু দেরি হয়ে গেলো , আসলে আসার আগে একবার রেওয়াজ করে এলাম তো তাই। তোমাদের এত বড় অনুষ্ঠান।

দাদু – বেশ করেছো দিদি, এস।

সে চললো।

আমাকে বুড়ো পকেটে হাত দিয়ে চুপি চুপি বললো – পালাবার কথা ভুলেও ভেবোনা, আলমারি কিন্তু এখনো খোলা আছে। যাও তানপুরাটা স্টেজে রেখে দিয়ে এসো হতভাগা।

আমি রাগ দেখিয়ে যেন মেয়ে পছন্দ নয়, শুধু ব্ল্যাক মেলিং এর ভয়ের জন্য চুপ করে আছি এমন একটা ভাব করলাম। আর মনে মনে বললাম – চালে ভুল করলে বুড়ো, এই মেয়েই তোমাকে টাইট দেবে, আমাকে কেস খাওয়াতে গিয়ে তুমিই একদিন কেস খাবে।

বিনোদিনী স্টেজে গান গাইছে — ” আমি তোমার প্রেমে হবো সভার কলঙ্কভাগী ” দাদুর ফেভরিট। চমৎকার গাইছে কিন্তু। নতুন করে রবীন্দ্রসংগীত শুনতে ইচ্ছা করছে।

 

আপনার মতামত জানান -

Top
error: Content is protected !!