এখন পড়ছেন
হোম > রাজ্য > নদীয়া-২৪ পরগনা > তরুণ স্কুল শিক্ষককে ‘মিথ্যা অভিযোগে’ বিডিওর চরম হেনস্থা – ক্ষোভে ফুঁসছে সুধীজন সমাজ!

তরুণ স্কুল শিক্ষককে ‘মিথ্যা অভিযোগে’ বিডিওর চরম হেনস্থা – ক্ষোভে ফুঁসছে সুধীজন সমাজ!


তরুণ প্রাথমিক শিক্ষকের দুটি আপাত নিরীহ প্রশ্ন – যা হয়ত আরো হাজার হাজার শিক্ষক-সহকর্মীর মনের কথা, আর তা প্রকাশ্যে আসতেই মেজাজ হারিয়ে, ‘হুইপ’ জারি করে, ‘সাসপেনশনের’ ভয় দেখিয়ে – নিজের ক্ষমতার অহমিকা প্রকাশের নিদারুন নমুনা রাখলেন বিডিও। আর যে ঘটনায় সোশ্যাল মিডিয়া তো বটেই রীতিমত শোরগোল পরে গেছে রাজ্য-রাজনীতিতে। ঘটনার সত্যতা জানতে প্রিয় বন্ধু বাংলার তরফে যোগাযোগ করা হয় সেই ‘নিগৃহীত’ শিক্ষক শাশ্বত ঘোষ ও সেদিনের ঘটনার সময় উপস্থিত বেশ কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গেও – আর সব মিলিয়ে যা উঠে এল, তা এক কথায় ‘মর্মান্তিক’।

আমরা প্রথমেই যোগাযোগ করি যাঁকে ঘিরে এই ঘটনা আবর্তিত সেই শিক্ষক শাশ্বতবাবুর সঙ্গে। শাশ্বতবাবু আমাদের জানান, গত ২৮ শে আগস্ট নাকাশিপাড়া বিডিও অফিসে আমাদের ডিও ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। সেইমত আমি বিডিও অফিসে গিয়ে সই করে নির্ধারিত ফাইলটি তুলি এবং ট্রেনিং রুমে যাই। সেখানে ঘন্টা দুয়েক ধরে ট্রেনিং চলা শেষ হলে ট্রেনিং নেওয়া দুই আধিকারিক আমাদের কাছে জানতে চান আমাদের কোনো প্রশ্ন আছে কিনা। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই আমি তাঁদের প্রশ্ন করি।

শাশ্বতবাবু আরো বলেন, আমি প্রথমেই জিজ্ঞাসা করি – এই ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ সাধারণত ১৫ দিন ধরে চলে, কিন্তু এবছর তা হতে চলেছে দুমাস ধরে। তারমধ্যে পুজোর ছুটিও পড়ছে – কি পরিস্থিতিতে এতদিন ধরে এই কাজ চলছে? আধিকারিকেরা জানান, এই প্রশ্নের উত্তর তাঁদের জানা নেই। এরপরে আমি প্রশ্ন করি, এই দুমাস ধরে যে কাজ করতে হবে – তার জন্য আমাদের প্রাপ্য কি হবে। এই প্রশ্নের উত্তরেও আধিকারিকেরা জানান, তাঁদের তা জানা নেই এবং বেশ উদ্ধতভাবেই আমাকে আমার প্রশ্নের উত্তর বিডিওর কাছ থেকে জেনে আসার ‘পরামর্শ’ দিলেন। ওই উদ্ধতভাবে দেখেই আমি বলি – ট্রেনিং দিচ্ছেন আপনারা অথচ ‘বেসিক ইনফরমেশন’ নেই আপনাদের কাছে – আমি কেন বিডিওর কাছে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যাব?

আরো খবর পেতে চোখ রাখুন প্রিয়বন্ধু মিডিয়া-তে

এবার থেকে প্রিয় বন্ধুর খবর পড়া আরো সহজ, আমাদের সব খবর সারাদিন হাতের মুঠোয় পেতে যোগ দিন আমাদের হোয়াটস্যাপ গ্রূপে – ক্লিক করুন এই লিঙ্কে

শাশ্বতবাবু আরো জানান, এই কথা শুনতেই ওই দুই আধিকারিক প্রচন্ড রেগে চেয়ার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান। ঘটনার কিছুক্ষন পরে, ৪-৫ জন আধিকারিক সহ ঘরে ঢোকেন বিডিও নিজে। আমি একটু পিছনের দিকে বসেছিলাম – আমাকে প্রায় জোর করেই একদম সামনে ডেকে নিয়ে গিয়ে হাতে মাইক্রোফোন ধরিয়ে দিয়ে জানতে চাওয়া হয় আমার প্রশ্ন। আমি বিডিওকেও প্রশ্ন করি, দুমাস ধরে এই ডিও ডিউটি করার জন্য আমার প্রাপ্য কত? জবাবে আমাকে বিডিও জানান, কমিশন এগুলো আগে থেকে ঠিক করে দেয় না – তাই আমিও আপনাকে জানাতে পারছিনা, আপনি কতো পাবেন। তবে বিগত বছরে যে হারে পেয়েছেন, তেমনই পাবেন। এরপরেই আমি জানাই, সঠিকভাবে আমার প্রাপ্য না জেনে, এই ডিউটি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

শাশ্বতবাবু বলেন, এই ঘটনার পরেই বিডিও রীতিমত উদ্ধতভাবে বলে ওঠেন – ‘বাই হুইপ’ এই ডিউটি আপনি করতে বাধ্য। আমি ওনার এই কথার বিরোধিতা করি, কারণ আমি যখন প্রাথমিক শিক্ষক হিসাবে চাকরিতে যোগদান করেছিলাম তখন কোথাও লেখা ছিলো না, যে আমি ডিও ডিউটি করতে বাধ্য থাকবো। সুপ্রিম কোর্টের আইন অনুযায়ী, জনগণনার কাজে, কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সরকারের সাহায্যে এবং ভোটগ্রহণের ও ভোটগণনার কাজে দায়িত্ত্ব নিতে আমরা, প্রাথমিক শিক্ষকরা বাধ্য। কিন্তু এই ডিওর ডিউটি করতে আমরা বাধ্য নই। তাই সেদিন আমি নিজের জায়গায় অনড় ছিলাম – যে কাজ করতে আমি বাধ্য নই, তার প্রাপ্য না জেনে আমি কি করে সেই দায়িত্ত্ব নেব? কিন্তু এতেই মেজাজ হারান বিডিও – তিনি আমাকে রীতিমত হলভর্তি লোকের সামনে আঙুল তুলে ভয় দেখতে থাকেন। তিনি বলেন – তিনি আমাকে এসআই, ডিআইয়ের মাধ্যমে সাসপেন্ড করাবেন।

শাশ্বতবাবুর বক্তব্য, তবে শুধু উনিই নন, ওনার সঙ্গে থাকা অন্যান্য অধিকারিকরাও তখন আমার উপর রীতিমত চাপ বাড়াতে শুরু করেছেন। কেউ বলছেন – একে দেখে রাখ, ব্যবস্থা করতে হবে – তো কেউ বলছেন – বিডিওর মুখের উপর কথা বলেন কি করে? এত চাপের মাঝে আমি বলে ফেলি – বিডিওর ডিপার্টমেন্ট আলাদা, আমার ডিপার্টমেন্ট আলাদা। আমার দুটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর ওনার জানা না থাকায়, উনি আমাকে সাসপেন্ড করার ভয় দেখান কিভাবে? এটা কি ওনার এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে? উনি আমাকে সাসপেন্ড করুন, তারপরে তাহলে ‘আইনানুগভাবে’ আমিও দেখে নেবো। এই ‘দেখে নেবো’ কথাটি শোনার পরেই যেন আগুনে ঘৃতাহুতি হয়, আমি যে তার আগে ‘আইনানুগ’ (লিগ্যালি) কথাটি বলেছি সেটি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে – বিডিওর আধিকারিকেরা আমাকে রীতিমত ঘিরে ধরেন। আমাকে তীব্রভাবে ভয় দেখানো শুরু হয় এবং এমনকি ঘর থেকে বেড়োতেও বাধা দেওয়া হয় আমাকে। কিন্তু কিছু সহকর্মীর প্রচেষ্টায় আমি ওখান থেকে শেষপর্যন্ত বেরোতে সক্ষম হই।

আমরা এই ঘটনায় সেদিন উপস্থিত অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথেও কথা বলি। অবশ্যই তাঁরা এই মুহূর্তে সামনে আসতে চাইছেন না বিডিওর ও তাঁর আধিকারিকদের ‘রোষানলে’ পড়ার ভয়ে। কিন্তু তাঁদের স্পষ্ট বক্তব্য, সেদিনের ঘটনায় বিডিও ও তাঁর আধিকারিকরা প্রত্যেকেই শাশ্বতবাবুর সঙ্গে প্রচন্ড উদ্ধত ও অপমানকর ব্যবহার করেছেন। শাশ্বতবাবুকে ঘিরে ধরে বিডিওর আধিকারিকেরা, বিশেষ করে অমল দাস বলে এক আধিকারিক (যিনি বর্তমানে অবসর গ্রহণের পর ক্যাসুয়াল ক্লার্ক হিসাবে কাজ করছেন), রীতিমত হুমকি প্রদর্শন করে গেছেন ও ভয় দেখিয়ে গেছেন। সামগ্রিক ঘটনায়, শাশ্বতবাবুর মত অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীরাও প্রচন্ড ক্ষুব্ধ ও আতঙ্কিত।

তবে ঘটনার শেষ এখানেই নয় – এই ঘটনার পরের দিন নাকাশিপাড়ার বিডিও কৃষ্ণনগরের ডিআই ও নদীয়ার সংসদের চেয়ারম্যানকে দুটি চিঠি পাঠিয়ে শাশ্বতবাবুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ‘অনুরোধ’ করেছেন। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, তিনি তাঁর চিঠির বয়ানে রীতিমত ‘মিথ্যা’ অভিযোগ নিয়ে এসেছেন! বিডিওর পাঠানোর মেমো অনুযায়ী, বিডিও সমগ্র ঘটনায় লজ্জিত – কারণ, শাশ্বতবাবু সেদিন তাঁর সঙ্গে নাকি অভদ্র ব্যবহার করেছেন, ট্রেনিংয়ে গিয়ে সই করেননি ও ডিও ডিউটি নেন নি! কিন্তু বাস্তবে সমগ্র ঘটনা ঘটেছে – নির্ধারিত ট্রেনিং শেষ হয়ে যাওয়ার পর প্রশ্নোত্তর পর্বে এবং শাশ্বতবাবু যে ডিও ডিউটি গ্রহণ করেছেন ও ‘কিট কালেকশন’ করেছেন তার প্রমান কিন্তু – নির্ধারিত জায়গায় তাঁর স্বাক্ষর!

তবুও, বিডিওর অভিযোগ পেয়ে ৩০ তারিখেই এসআই শাশ্বতবাবুকে একটি শো-কজ নোটিশ পাঠান এবং তিন দিনের মধ্যে তার উত্তর দিতে বলেন। কিন্তু, প্রশাসন এক্ষেত্রে অতিরিক্ত সক্রিয় – আর তাই শাশ্বতবাবুর জবাবের জন্য তিন দিন অপেক্ষা না করেই – তার পরের দিন অর্থাৎ ৩১ তারিখ স্বয়ং চেয়ারম্যান শাশ্বতবাবুকে হিয়ারিংয়ের জন্য ডেকে পাঠান! শাশ্বতবাবুর বক্তব্য, পাবলিক হলিডে ও শনি-রবিবারের ছুটির জন্য তিনি শো-কজ লেটার পাওয়ার পর গতকাল পর্যন্ত এসআই অফিস বন্ধ ছিল। আজ সকালে এসআই অফিস খুললেই, তিনি সেই শো-কজের জবাব দেবেন। অন্যদিকে, বিকেল ৩ টের সময় চেয়ারম্যান যে হিয়ারিংয়ের জন্য ডেকেছেন – সেখানেও তিনি যাবেন।

তবে সামগ্রিক ঘটনায় ক্ষোভ বাড়ছে শিক্ষক-সমাজে ও সুশীল-সমাজে। আর তাই, সামগ্রিক ঘটনায় শাশ্বতবাবু একা নন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাশে পাচ্ছেন বহু মানুষকেই। প্রশাসনিক কর্তাদের এই ক্ষমতার ‘অহমিকা’ প্রকাশে তাঁরা আজ রীতিমত ক্ষুব্ধ। আর তাই, আজ যখন চেয়ারম্যান অফিসে শাশ্বতবাবু যাবেন – তখন সমগ্র ঘটনার প্রতিবাদে – বহু শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষক সমাজের এক বৃহদংশ তাঁর সমর্থনে সেখানে একত্রিত হবেন। অন্যদিকে, এই লড়াই এত সহজে ছেড়ে দিতে রাজি নন – ‘ক্ষুব্ধ’ ও ‘অপমানিত’ শিক্ষক সমাজ। সুবিচারের আশায় – তাঁরা কিন্তু এবার আদালতমুখী হওয়ার কথাও ভাবছেন। সুতরাং বাংলার ‘শিক্ষক-সমাজের’ ‘বঞ্চনার’ ইতিবৃত্তে শাশ্বতবাবুর এই ঘটনা আরেকটি নতুন অধ্যায় যোগ করল বলেই সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা।

আপনার মতামত জানান -

Top
error: Content is protected !!