এখন পড়ছেন
হোম > বিশেষ খবর > মুকুল রায়ের পরবর্তী বিজেপি রাজ্য সভাপতি হওয়ার সম্ভাবনা কতটা?

মুকুল রায়ের পরবর্তী বিজেপি রাজ্য সভাপতি হওয়ার সম্ভাবনা কতটা?


একসময় মুকুল রায় ছিলেন দলের অঘোষিত দুনম্বর নেতা। হঠাৎ করে হয়ে যাননি, নিজের যোগ্যতা দিয়ে ধীরে ধীরে একদম পিছন থেকে উঠে এসে দলনেত্রীর কাছ থেকে কার্যত ছিনিয়ে নেন সেই স্থান। আর মমতা-মুকুল জুটি যে ‘সুপারহিট’ ছিল একের পর এক নির্বাচনে তৃণমূলের চোখ ধাঁধানো সাফল্যে প্রমাণিত। মুকুল রায় কোনোদিনই নিজেকে ‘জননেতা’ হিসাবে তুলে ধরেননি, আর ‘ঈশ্বরদত্ত’ সেই সহজাত প্রতিভা ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। একের পর এক সভায় তাৎক্ষণিক ছড়া তৈরি করে মিষ্টি ভাষায় বিরোধীদের বেঁধার মত ক্ষমতা শুধু বাংলা কেন গোটা ভূ-ভারতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে টক্কর দেওয়ার মত রাজনীতিবিদ খুব কমই আছেন। অন্যদিকে, বাঁকুড়া বা মালদহের কোনো প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে পড়ে থেকে সংগঠনটাকে তৈরি করার বা অনাড়াম্বরে ঘরে বসে ভোটের অঙ্ক মেলানোর নীল-নক্সা তৈরি করাতে মুকুল রায়ের জুড়ি মেলা ছিল ভার। আর তাই পিছন থেকে উঠে এসে অনেক হেভিওয়েটকে পিছনে ফেলে দলনেত্রীর আস্থা ছিনিয়ে নেওয়াটা অবশ্যম্ভাবী ছিল মুকুল রায়ের।

কিন্তু, বেশ কিছু কারণে সেই জুটি ভেঙে গেল। মুকুল রায় তৃণমূল কংগ্রেস ত্যাগ করে বিজেপিতে যোগ দিলেন। জনশ্রুতি সেটা না করলে, তৃণমূল কংগ্রেসই সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করত, আর তাই নিজের রাজনৈতিক জীবন টিকিয়ে রাখতেই বড়সড় ‘রিস্কটা’ নিয়েই ফেললেন বাংলার তৃণমূলের ‘চানক্য’। কি কারণে এই বিরোধ? সব থেকে ভালো উত্তরটা বলতে পারবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা মুকুল রায় নিজে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা প্রকাশ্যে এই দুই নেতা যা বলছেন তা মোড়কে ঢাকা, আসল কথাটা কেউই বলছেন না বা বলতে পারছেন না। তবে বাতাসে দুটো জল্পনা ঘোড়ে – প্রথমত, আর্থিক চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে যখন একের পর এক তৃণমূল নেতার নাম জড়াচ্ছে, তখন নিজেকে বাঁচাতে মুকুলবাবু নাকি মুখ্যমন্ত্রীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও স্নেহভাজন এমন একজন নেতার নামে তথ্য সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছেন যা ‘ভবিষ্যতের তৃণমূল’ নেতৃত্ত্বকে আতান্তরে ফেলতে পারে। দ্বিতীয় মত হল, নিজে সংগঠন তৈরি করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শাসকের আসনে বসাতে সাহায্য করেছেন মুকুল রায়, নিজে নেননি সেই ক্ষমতার ভাগ। কিন্তু বদলে তিনি চেয়েছিলেন, দলের প্রার্থী নির্বাচন থেকে যাবতীয় সাংগঠনিক ক্ষমতা নিজের হাতে রাখতে। যা কিছুতেই মেনে নেননি তৃণমূল নেত্রী। কেননা দলটা তাহলে বকলমে চলে যেত মুকুল রায়ের ‘দখলে’, আর সেখান থেকেই প্রথমে মতান্তর পরে মনান্তর। কিন্তু এদুটিই জল্পনা, এর সত্যতা নিয়ে কোথাও এখনো প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় নি।

যাইহোক, এবার আসা যাক বিজেপি প্রসঙ্গে। ঐতিহাসিক ভাবেই বাংলায় সেভাবে কখনো দাঁত ফোটাতে পারেনি গেরুয়া শিবির, কিন্তু ২০১৯ এ কেন্দ্রে ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে বাংলার উপর ভরসা করা ছাড়া উপায় নেই তাদের, আর তাই অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে মুকুল রায়কে শেষপর্যন্ত দলে নিল বিজেপি। বিজেপিতে যোগ দিয়েই দক্ষ সংগঠক মুকুল রায় দলের মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠা ও দলে সমন্বয়ের চেষ্টা করলেন, বিজেপির নিচুতলার কর্মীরাও উৎসাহিত তাঁকে নিয়ে। কিন্তু কোথাও যেন তেলে-জলে ঠিক মিস খাচ্ছে না! অনেক নেতাই নাকি ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ভীত। ফলে বঙ্গ বিজেপিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে মুকুল রায়ের প্রতিটা পদক্ষেপেই হচ্ছে তীব্র বিরোধিতা, কিন্তু সুখের কথা বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ত্ব এখনো তাঁর পাশেই। আর তাই, বাংলায় বিজেপির রাজ্য সভাপতির পরিবর্তন করার জল্পনা যখন চূড়ান্ত, তখনই প্রবলভাবে ভেসে উঠছে মুকুল রায়ের নাম। কিন্তু সত্যিই কি দিলীপ ঘোষকে সরিয়ে অমিত শাহরা মুকুল রায়ের হাতে এত বড় দায়িত্ত্ব তুলে দেবেন?

এই প্রসঙ্গে আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলি। তাঁদের মত, না এখনই তা হওয়ার সম্ভাবনা কম। তার প্রধানত দুটো কারণ – প্রথমত, যতই মুকুল রায়কে ঘিরে নিচুতলায় উৎসাহ থাক, তিনি সবে দলে এসেছেন। সুতরাং দলে এসেই এত বড় দায়িত্ত্ব পেয়ে গেলে দীর্ঘদিনের দলীয় নেতারা বেঁকে বসতে পারেন, অসহযোগিতার চূড়ান্ত হতে পারে। দ্বিতীয়ত, সবে মুকুলবাবুকে পঞ্চায়েতের দায়িত্ত্ব দেওয়া হয়েছে, এই অবস্থায় মুকুলবাবু যে আসলে ‘ফ্লপ নেতা’ সেটা বোঝাতে মরিয়া হবে শাসকদল। সুতরাং পঞ্চায়েতে যদি ‘গায়ের জোরে’ খারাপ ফল হয়, সেখানে রাজ্য সভাপতি হিসাবে মুকুল রায়ের নামে ‘অপপ্রচার’ করতে কোনো কসুরই ছাড়বে না তাঁর প্রাক্তন দল। তাই এই মুহূর্তে ‘সেফ গার্ডে’ রাখা দরকার তাঁকে বিজেপির নিজের স্বার্থেই। সবথেকে বড় কথা, পঞ্চায়েতের ৫৮ হাজার বুথের দায়িত্ত্ব সামলে যদি রাজ্য সভাপতির দায়িত্ত্বও তাঁকে বইতে হয় তাহলে হয়ত কোনোটাই ঠিক ভাবে হবে না। কেননা বহু রাজনৈতিক নেতাই, বিশেষ করে ‘মুকুল-পন্থীরা’ এখনো জল মাপছেন, যদি পঞ্চায়েতে হাওয়া ঘোড়ার আভাস থাকে, তবেই সব দুদ্দাড়িয়ে গেরুয়া শিবিরে নাম লেখাবেন, নাহলে শাসকদলের নিশ্চিত আশ্রয়ই তাঁদের কাছে শ্রেয়।

তাহলে, সত্যিই যদি দিলীপ ঘোষকে বিজেপি রাজ্য সভাপতির পদ থেকে সড়ে যেতে হয়, কে আসতে পারেন তাঁর জায়গায়? এক্ষেত্রেও বিশেষজ্ঞদের মত, বিজেপি নিজেদের পন্থাতেই, কোনো সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ নেতাকে বসাবেন সেই আসনে। তিনি রাজ্য রাজনীতিতে পরিচিত মুখ শমীক ভট্টাচার্য হতে পারেন অথবা রাজ্য রাজনীতিতে অপরিচিত কিন্তু বিজেপির সাংগঠনিক মহলে বড় দায়িত্ত্ব সামলানো ডাঃ চন্দন সেন, বিধান কর বা আশীষ সরকার হতে পারেন। তবে কি মুকুল রায় কোনোদিনই বিজেপি রাজ্য সভাপতি হতে পারবেন না আরএসএস ঘনিষ্ঠ না হওয়ায়? এক্ষত্রে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিজেপি নেতার কথায়, পঞ্চায়েতে যদি ‘দাদা’ অসাধ্যসাধন করে ২০০৮ এর তৃণমূলের জায়গাতে নিয়ে যেতে পারেন, তাহলে দলবদলের হিড়িক লাগবেই আর তখন তৃণমূলকে ভাঙতে ২০১৯ এর লোসাভার ঠিক আগে সময়মত তাঁকে বিজেপি রাজ্য সভাপতি করে দেওয়া হতে পারে। আর সেই জন্যই আপাতত তাঁকে রাজ্যসভার সাংসদ বা কেন্দ্রে মন্ত্রীত্ত্ব কিছুই দেওয়া হল না, বড় পরিকল্পনা আছে বলেই। কেননা মুকুলবাবু হলেন তৃণমূল ভাঙানোর সব থেকে বড় ওষুধ, তিনি যদি বিজেপিতে এসে কোনো সম্মনজনক পুনর্বাসন না পান, ও দল ছেড়ে কেউ আসবেন না। তবে আসলে কি হবে তা জানতে বোধহয় এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই, ওই সময়েই রাজ্যে আসছেন বিজেপির আসল ‘মাস্টারমাইন্ড’ অমিত শাহ। সাংগঠনিক কি ঝাকুনি তিনি সেই সময় দেবেন সেদিকেই তাকিয়ে নিচুতলা থেকে শুরু করে শীর্ষনেতৃত্ত্ব। তবে বাংলা দখল অমিতজির পাখির চোখ আর সেটা করতে যেটা ঠিক তিনি মনে করবেন সেটাই তিনি করবেন।

আপনার মতামত জানান -

Top
error: Content is protected !!