এখন পড়ছেন
হোম > রাজ্য > পুরুলিয়া-ঝাড়গ্রাম-বাঁকুড়া > উদাসীনতা ও বাণিজ্যিকরন – একদা গর্বের ‘সাহেব বাঁধ’ নিয়ে প্রবল আতঙ্কে পুরুলিয়া-বাসী

উদাসীনতা ও বাণিজ্যিকরন – একদা গর্বের ‘সাহেব বাঁধ’ নিয়ে প্রবল আতঙ্কে পুরুলিয়া-বাসী


রাহুল চক্রবর্তী, পুরুলিয়া: পুরুলিয়া শহরের মাঝামাঝি অবস্থিত নিবারণ সায়র। তবে এই নিবারণ সায়র সকলের কাছে পরিচিত “সাহেব বাঁধ” নামে। এই সাবেকী নামটা জেলার আবালবৃদ্ধবণিতার অতি প্রিয়। নামটাই প্রমাণ করে দেয় জলাশয়টি এই জেলার বহু ইতিহাসের সাক্ষী। জেলার পানীয় জলের উৎসগুলোর মধ্যে অন্য়তম ও গুরুত্বপূর্ণ হল এই শতাব্দী প্রাচীন জলাশয়টি, সারাবছরই জল টলমল করে। কয়েক বছর আগে এই বিশাল জলাশয়টি পেয়েছে জাতীয় সরোবরের তকমা। পুরুলিয়া পৌরসভা বিগত কয়েক দশক ধরে সাহেব বাঁধকে ঘিরে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করে চলেছে, নেওয়া হয়েছে একটার পর একটা পরিকল্পনা। মূলত এটির সংস্কার ও সৌন্দর্য্যায়নই প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। কেন্দ্র সরকারের তরফ থেকেও বেশ কয়েকবার এই উদ্দেশ্য় এসেছে মোটা বরাদ্দ, মাঝেমাঝেই চলে কচুরীপানা সাফাই অভিযাণ। কয়েক মাস আগেই শেষ হয়েছিল বহু অর্থ খরচ করে সমস্ত জলাধারটি সিমেন্টের পিলার ও জাল দিয়ে ঘেরা দেওয়ার কাজ, করা হয়েছিল নীলসাদা রং। এমনকি বানানো হয় বেশ কয়েকটা বাগান, হাঁটার জন্য় পৃথক যায়গা, চারিপাশে বসার জায়গা আলো ইত্য়াদি। একই সঙ্গে সার দিয়ে লাগানো হয়েছিল পাম সহ অন্য়ান্য় বহু দামী দামী গাছ – কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই জলাশয়টি এবং সংলগ্ন এলাকার বর্তমানে যা পরিস্থিতি তা এক কথায় বলার নয়।

এবার থেকে প্রিয় বন্ধুর খবর পড়া আরো সহজ, আমাদের সব খবর সারাদিন হাতের মুঠোয় পেতে যোগ দিন আমাদের হোয়াটস্যাপ গ্রূপে – ক্লিক করুন এই লিঙ্কে

প্রাতঃভ্রমণকারীদের সঙ্গে এই জলাশয়টির বিষয়ে কথা বললেই বেরিয়ে আসে একরাশ আক্ষেপ ও হতাশা। তাঁদের মতে জলাধারটির চারিপাশে জমা হয়েছে নোংরা আবর্জনা, সবচেয়ে ভয়ংকর হলো চারপাশে পারথেনিয়ামের জঙ্গল। তাঁদের আরও অভিযোগ এই জলাশয়ের ধারে বাচ্চাদের পার্কগুলিতে এবং হাঁটাচলার রাস্তাতেও এই গাছগুলি দেখা যায়। জলাশয়ের ধারেই রয়েছে একটি বাচ্চাদের স্কুল, অভিভাবকেরা মাঝেমাঝেই জলাশয়ের পাড়ে জমে থাকা কচুরীপানার দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। শহরবাসীর একাংশ ইতিমধ্য়েই পৌরসভার গাফিলতিকেই দায়ী করছেন সাহেব বাঁধের বর্তমান এই অবস্থার জন্য়। তাঁদের মতে কচুরীপানাতে আবার পূর্ণ হতে চলেছে এই জলাধারটির একাংশ। অন্য়দিকে এতো দামী গাছ যেগুলো রোপণ করা হয়েছিল কয়েকমাস আগে তা পৌরসভার গাফিলতিতে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তবে আশার কথা, আবারও নতুন করে কাজ শুরু হয়েছে। কয়েকমাস আগের সদ্য় সমাপ্ত জাল দিয়ে ঘেরা ও রং করা সিমেন্টের খুঁটিগুলি তুলে নতুন করে আবার ঘেরা দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। শহরবাসীর একাংশ জানাচ্ছেন, সাহেব বাঁধকে নতুন করে সাজিয়ে তোলার জন্য়ই কাজ হচ্ছে।

তবে এর পাশাপাশি এই কাজ গুলোর বিরুদ্ধে জনমতও রয়েছে যা অস্বীকার করা যায়না। এই জেলার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গবেষকের দাবী, ‘জলাশয়টি অত্য়ন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটিকে বাঁচানোর জন্য় সকলের এক হয়ে লড়াই করার দরকার। সঠিক পরিকল্পনার অভাবের জন্য় কয়েক একর বিস্তৃত এই জলাশয়টি সহ এর আশপাশের এলাকা বারংবার কাঁটাছেড়া করতে হচ্ছে’। সরকার যখন অর্থের অপচয় বন্ধে উদ্য়োগী সেইসময় মাত্র কয়েকমাস আগের খুঁটি উপরে নতুন করে এই কাজগুলিকে সঠিক পদক্ষেপ বলে মানতে নারাজ অনেকেই। তাঁদের মতে এই বারংবার নির্মাণ কার্য়ের ফলে ক্ষতি হচ্ছে এই শতাব্দী প্রাচীন জলাশয়টির, যা আরো বেশী চিন্তার কারণ। প্রবীণ নাগরিকদের মতে জলাশয়টির আকার আগের তুলনায় অনেক হ্রাস পেয়েছে, নষ্ট হচ্ছে জলের স্রোত। এমনকি গ্রীষ্মের অনেক আগে থেকেই এতো বিশাল জলাশয়ের আশপাশের এলাকাগুলিতেও দেখা দিচ্ছে জলের তীব্র সমস্য়া। তাই অনেকেই মনে করেন এটি রক্ষা করতে দরকার জনসচেতনতারও। শহরের পরিবেশপ্রেমীদের দাবি, তাঁদের দীর্ঘদিনের দাবী মেনে বেশ কয়েক বছর হল এখানে প্রতিমা বিসর্জন বন্ধ করা হয়েছে।

তবে জনসচেতনতার অভাবে আশপাশে গড়ে উঠছে একটার পর একটা বহুতল আবাসন, হোটেল, রেস্তোঁরা – এমনকি গাড়ির গ্যারেজও। জলাশয়ের ধারের হঁটাপথগুলিও কার্যত জবরদখল হয়ে গেছে। এমনকি জনৈক শাসকদল-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী কিভাবে এইরকম এক গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় রাস্তা জবরদখল করে হোটেল ব্য়বসা চালাচ্ছেন তা দিন কয়েক আগে স্থানীয় এক সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিল, এলাকাবাসীরাও এই বিষয়ে সহমত। পরিবেশপ্রেমীদের অনেকে বলছেন জলাশয়টির চারপাশে তীব্র আলো ও ঘেরা দেওয়ার ফলে দেখতে ভালো লাগে তবে এই আলো গুলোর তীব্রতা এতো বেশি এবং যেভাবে লাগানো হয়েছে তাতে তা পরিবেশ-বান্ধব থাকছে না। ফলে বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে কমে যাচ্ছে পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা। শোনা যাচ্ছে নৌকাবিহার থেকে ভাসমান বাজার – সৌন্দর্য্যায়নের জন্য একাধিক ব্যবস্থা করা হচ্ছে। জলাশয়টিতে বর্তমানে ছোট একটি দ্বীপের মত এলাকা রয়েছে যেখানে বহু বিরল প্রজাতির ছোট-বড় গাছ ও বিভিন্ন পাখির দেখা মেলে। উল্লেখ্য় যে এই জলাশয়টিকে ঘিরে বোটানিকাল ও জুলজিকাল গবেষণার জন্য়ও রয়েছে বহু সুযোগ, অথচ গত কয়েক মাস ধরে যে ভাবে এই এলাকায় গাছ নিধণ চলছে তা নিয়ে সকলেই প্রায় উদাসীন। পৌরসভা তথা বন দপ্তরের আরও বেশি করে এই বিষয়গুলির দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন বলে মনে করছেন স্থানীয় অধিবাসীরা। শহরের অনেকেই অবশ্য (বিশেষত প্রবীণ নাগরিকেরা) সাহেব বাঁধের এইসব নতুন পরিকল্পনাকে আদতে ‘বাণিজ্যিকরন রূপে’ দেখছেন এবং বিষয়টা তাঁরা মোটেও মেনে নিতে পারছেন না। তাঁদের অভিমত, পুরুলিয়ার মতো ক্ষরা-প্রবণ জেলাতে পরিবেশ এবং জল সংক্রান্ত বিষয় যদি দিনের পর দিন অবহেলিত হতে থাকে তবে তা হবে অদূর ভবিষ্যতে এই শহর তথা জেলার জন্য় নিশ্চিতভাবে ক্ষতিকারক ও আত্মহণনকারী সিদ্ধান্ত।

আপনার মতামত জানান -

Top
error: Content is protected !!