এখন পড়ছেন
হোম > জাতীয় > মমতা ব্যানার্জি কি সত্যিই ‘তিন তালাক বিরোধী’ নাকি সবটাই রাজনীতি? দেবাংশু ভট্টাচার্য্য

মমতা ব্যানার্জি কি সত্যিই ‘তিন তালাক বিরোধী’ নাকি সবটাই রাজনীতি? দেবাংশু ভট্টাচার্য্য

লোকসভায় হইহই করে পাশ হল তিন তালাক বিল। তৃণমূল কংগ্রেসের চৌত্রিশ জন সাংসদ কিন্তু একদম চুপ ছিলেন, না পক্ষে মত দিয়েছেন, না বিপক্ষে। রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন ছিল, এই চুপ থাকার কারণ কি তবে ‘দুই নৌকায় পা’ দিয়ে চলা? এই ‘চুপ’ থাকার কারণ কি মুসলিম সমাজের পুরুষ বা মহিলা, কাউকেই চটাতে না চাওয়া? প্রশ্ন জাগাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, বিশেষ করে যখন লোকসভার তৃতীয় বৃহত্তম বিরোধী শক্তি কোনো একটি বিষয়ে মৌনতা অবলম্বন করে। কিন্তু সেই ‘মৌনতা’ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, রাজ্যসভায় তিন তালাক বিলটিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবিতে তৃণমূল কংগ্রেসের গলার স্বর ছিল সবচেয়ে দৃঢ়। শুধুমাত্র পাঞ্জাবের শিরোমণি অকালি দল বাদ দিলে, আর কোনো এনডিএ শরিকও বিজেপির সঙ্গ দেয়নি রাজ্যসভায়। আর এখানেই ওঠে প্রশ্নটা – কেন?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই সেই উত্তর খোলসা করেছেন। একটি সরকারি জনসভায় তিনি জানিয়েছেন, লোকসভায় বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় সেখানে এই বিলের ত্রুটিপূর্ণ অংশের বিরোধিতা করেও লাভ হত না, বহুমতের ক্ষমতায় অতি মসৃণ ভাবেই তাকে পাশ করিয়ে নিতে সক্ষম হত বিজেপি, তাই সেখানে বিরোধিতার সুর তুলে অকারণে পরিশ্রম করেনি তাঁর দল। বিষয়টি খুব একটা ভুল যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেননি তার প্রমাণ লোকসভায় এই বিল পাশ হাওয়া। কিন্তু মজার বিষয় হল, লোকসভায় পরোক্ষ সমর্থন দিয়েছিল বিজেপির এমন শরিক দলও তৃণমূলের সাথে গলা মিলিয়ে রাজ্যসভায় বিলটিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবি তুলল এবং বিরোধী ঐক্য ও এনডিএ শরিকদের বুঝিয়ে বিলটিকে আখেরে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠাতে সক্ষম হল তৃণমূল কংগ্রেস।

বলে রাখা ভালো, এই সিলেক্ট কমিটির কাজ হল যে কোনো বিলের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করা এবং তার মধ্যেকার ত্রুটিগুলি নিয়ে বিবেচনা করে বদলানোর পরামর্শ দেওয়া। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, মমতা বন্দোপাধ্যায় হঠাৎ করে এই বিলকে এই কমিটিতে পাঠানোর পক্ষে কেন? কারণটা নিজেই স্পষ্ট করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী। আর তাতেই স্পষ্ট হয়ে গেছে যে আখেরে তিনি তিন তালাক বিলের পক্ষেই। একটি সরকারি জনসভায় তিনি বলেছেন, আমরা এই বিলের বিরোধিতা করিনি কারণ আমরাও মুসলিম মহিলাদের মুক্তির পক্ষে। কিন্তু রাজনীতি করতে গিয়ে তাড়াহুড়োয় বিজেপি যে বিলটি এনেছে, তা আসলে সমস্যায় ফেলবে মুসলিম মহিলাদেরই।

সত্যিই কি এই বিলে এমন কিছু আছে যাতে সমস্যায় পড়তে পারেন মুসলিম মহিলারা? কিংবা এই বিলের কোন “ত্রুটি” গুলির কথা বলছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যার জন্য বিলটিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর পক্ষে সওয়াল করলেন তিনি? আমি নিজে এই বিলটির সম্পর্কে ভেবে দেখলাম, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিন্তা মোটেই অমূলক নয়।

১. সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুসারে, ‘তাৎক্ষণিক তিন তালাক’ অবৈধ। আমরা জানি, ‘অবৈধ’ কথার অর্থ যা বৈধ নয় এবং অবৈধ কিছু ব্যবহার বা অবৈধ কাজ করলে – আইনত শাস্তি পেতে আপনিও বাধ্য। এবার ধরুন কোনো মুসলিম মহিলাকে কোনো পুরুষ হঠাৎ সকালবেলা উঠে তিন তালাক দিয়ে বসলেন! এই বিলে বলা আছে, তিন তালাক প্রাপ্ত সেই মহিলা তাঁর নিকটবর্তী থানায় গিয়ে অভিযোগ করতে পারেন এবং অভিযোগ পাওয়ামাত্র তাঁর স্বামী গ্রেফতার হবেন। তারপর যথারীতি মামলা চলবে এবং পরবর্তীতে দোষী প্রমাণিত হলে তিন বছরের জেল হবে। এখন ভাবুন, যেহেতু তিন তালাক অবৈধ, তাই ওই পুরুষ তালাক দিলেও আইনত কিন্তু তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি, এই মহিলা এখনও সেই পুরুষের স্ত্রী – তাই ওই মহিলা অন্য কোথাও বিয়েও করতে পারবেন না। তাহলে এই মামলা চলাকালীন ও শাস্তির তিন বছর সেই মহিলার, তাঁর সন্তানের খাওয়া-পড়ার ভার নেবেন কে?

২. সুপ্রিম কোর্টের একটি নির্দেশ অনুযায়ী, তিন তালাক প্রাপ্ত মহিলারাও ভরন-পোষনের দাবি করতে পারেন। তাহলে প্রশ্ন, স্বামী যদি তিন বছর জেলই খাটেন, তিনি স্ত্রীকে ভরন-পোষনের টাকা দেবেন কি ভাবে?

৩. সব চাইতে মৌলিক প্রশ্ন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী তাৎক্ষণিক তিন তালাক দেওয়া অবৈধ এবং বিলটিতে উল্লেখ আছে ‘তাৎক্ষণিক তিন তালাক দিলে….’ কি কি শাস্তি হতে পারে ইত্যাদি। এখন যদি তিন তালাক অবৈধ হয়, তার অর্থ এই যে কোনো পুরুষ তিন তালাক দিলেও তা ব্যর্থ হবে অর্থাৎ সহজ ভাষায় তিন তালাক হচ্ছে না। কিন্তু বিল অনুযায়ী তিন তালাক দিলে তবেই শাস্তি হতে পারে! এখন যে তিন তালাক হয়ইনি, তার জন্য একজন কিভাবে শাস্তি পেতে পারেন? মোদী সরকারের আনা বিলের এই অন্যতম বড়ো ফাঁকটি গলে কিন্তু বহু অপরাধীই পার পেয়ে যাবেন, বিপদে পড়বেন মহিলারাই।

৪. এবার ধরুন তিন বছর জেল খাটার পর স্বামী ‘ঘরে’ ফিরলেন। তিনি কি আর তাঁর স্ত্রীকে ( যাঁর ‘জন্য’ তাঁর জীবনের তিন-তিনটি বছর কাটল গারোদের পিছনে) স্বীকার করবেন? হতেই পারে তখন আইনত ডিভোর্সের প্রক্রিয়া শুরু করলেন সেই পুরুষ, তিন তালাক থেকে রক্ষা পেলেও তারপর কোথায় যাবেন সেই মহিলা?

৫. পুরুষটি জেলে থাকাকালীন মহিলার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কি সেই মহিলার যত্ন নেবেন যাঁর ‘জন্য’ তাঁদের পরিবারের ছেলে আজ জেলে? তখন শ্বশুরবাড়ির ‘নির্যাতন’ থেকে মহিলাকে রক্ষা সরকার বাহাদুর করবেন কি?

৬. একদিকে বলা হচ্ছে তিন তালাক অবৈধ, আরেকদিকে বলা হচ্ছে তিন তালাক দিলে জেল হবে। আমার প্রশ্ন, যে অপরাধটি ঘটলই না (যেহেতু অবৈধ, তাই দিলেও তালাক হবে না) তার জন্য শাস্তি কিভাবে হতে পারে? ঠিক যেমন ‘খুন’ এবং ‘খুন করার চেষ্টা’ দুটি সম্পূর্ণ আলাদা, তেমনই এই বিলে ‘তিন তালাক দেওয়া’ তুলে ‘তিন তালাক দেওয়ার চেষ্টা’ করলে তবেই এই আইন প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি দিতে পারে।

৭. তিন তালাক বিলের অপব্যবহারের আরেকটা দিকও উঠে আসছে, অনেকটা ঠিক ৪৯৮ এ-র মত, এক্ষেত্রেও একজন মহিলা থানায় গিয়ে অভিযোগ করলে তৎক্ষণাৎ সেই পুরুষ গ্রেফতার হবেন। বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, এক শ্রেণীর মহিলা, এক শ্রেণীর পুলিশ ও এক শ্রেণীর উকিলের যৌথ ব্যবস্থাপনায় ৪৯৮ এ-র বহুল অপব্যবহার, যার দরুন বহু নিরপরাধ পুরুষও জেলের ওপারে যাচ্ছেন। নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে ফিরে আসার পরেও সামাজিক প্রতিষ্ঠা, রোজগার সব হারিয়ে পথে বসতে হচ্ছে সেই পুরুষকে। এখন এই বৈষম্যমূলক তিন তালাক বিরোধী বিলও একশ্রেণীর মানুষের কাছে ব্যবসা হয়ে উঠলে তা আটকাতে কি সংস্থান থাকছে এই বিলে? কারণ ৪৯৮ এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ, বহুল অপব্যবহারের আসল নির্যাতিতারা বিচার পাচ্ছেন না। এক্ষেত্রেও এমনটা হবে না কি গ্যারান্টি আছে?

৮. এখন প্রমাণ করতে পারা বা না পারার এই লম্বা আইনি প্রক্রিয়ায় মহিলার আইনি খরচ তো সেই পুরুষ বহন করবেন না – এটাই বাস্তব, সেক্ষেত্রে এই ব্যয় একজন মহিলার পক্ষে বহন করা সম্ভব কি? সরকার কি এই বিলে মহিলার জন্য সরকারি উকিল পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা রাখছেন?

৯. এই বিলে বলা হচ্ছে, অভিযোগ করার পর মহিলাকে প্রমাণ করতে হবে যে সেই পুরুষ সত্যই তাকে তিন তালাক দিয়েছিলেন। এখন তিন তালাক যদি হোয়াটসঅ্যাপে, এসএমএসে বা ভিডিও ম্যাসেজে দেওয়া হয় তা প্রমাণ করা যথেষ্ট সহজ হবে। কিন্তু আমরা জানি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিন তালাক মুখে বলা হয়। তখন এই মহিলার পক্ষে কী করে প্রমাণ করা সম্ভব যে সেই পুরুষ তাকে তিন তালাক দিয়েছেন?

এখন এই নয়টি পয়েন্ট যদি দেখেন, এগুলি আখেরে একজন নির্যাতিতা মহিলার পক্ষে আরও বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু নোট বাতিল থেকে জিএসটি, মোদী সরকারের যেকোনো কাজে তাড়াহুড়োর ঘটনা আমরা সকলেই দেখেছি। এই তাড়াহুড়ো করে ‘বদলের কান্ডারী’ তকমা কুড়ানোর চেষ্টা আসলে কলার উঁচু করার রাজনীতি, যার কুফল বার বার ভোগ করতে হয়েছে দেশকে, দেশবাসীকে। জিডিপির মুখ থুবড়ে পড়া, মূল্যবৃদ্ধি থেকে ব্যবসার ক্ষতি – এ সবই যার জলজ্যান্ত প্রমাণ। এমনই তাড়াহুড়োয় আরেক কান্ড ঘটাতে চলেছিল মোদী সরকার। কিন্তু সম্মিলিত বিরোধী দল রাজ্যসভা থেকে এই বিল সিলেক্ট কমিটিতে পাঠাতে সমর্থ হয়েছেন আর যার নেতৃত্ত্ব দিয়েছেন আমাদের বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তাঁর দল।

অন্যদিকে, সরকার পক্ষের থেকে একটি মিথ্যা প্রচার চালানো হচ্ছে এই বলে, যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল নাকি তিন তালাক বিলের বিপক্ষে। আমার প্রশ্ন, যদি তাঁরা বিপক্ষেই হতেন, তবে লোকসভায় তাঁরা চুপ থেকে রাজ্যসভাতেও এই বিলের বিপক্ষে ভোট না দিয়ে উল্টে তাঁরা বিলটিকে আরও মজবুত করতে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবি কেন তুললেন? ‘ক্রেডিট’ নেওয়ার রাজনীতি করতে গিয়ে সরকার পক্ষের দল সম্ভবত যুক্তিবোধের ধার ধারছেন না, যেটা আখেরে সুস্থ রাজনীতির বা গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক।

এই দেশের একজন প্রগতিশীল সাধারণ মানুষ হিসাবে তাৎক্ষণিক তিন তালাকের বিপক্ষে আমিও। তাই সর্বান্তকরণে এই বিলকে সমর্থন করি এবং ঠিক একই কারণে এই বিলকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠাতে চাওয়ার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্তকে দ্বিগুণ সমর্থন করি, যেন মোদী সরকারের আনা এই “ত্রুটিপূর্ণ” বিল আখেরে সেই মুসলিম মহিলাদের জন্যেই বিপদের কারণ না হয়ে দাঁড়ায় এবং চোখে পড়ার মত বড়ো বড়ো ফাঁক গুলি দিয়ে যেনো আসল অপরাধী বেরিয়ে আসতে না পারে।

দেবাংশু ভট্টাচার্য্য
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক

** এই লেখায় প্রকাশিত মতামত সম্পূর্ণরূপে লেখকের নিজস্ব, প্রিয় বন্ধু মিডিয়ার কোনো মতামত নয়।

আপনার মতামত জানান -

Top
error: Content is protected !!