এখন পড়ছেন
হোম > অন্যান্য > অকালে প্রেমের বোধন – কলমে – অপরাজিতা , পর্ব ১২

অকালে প্রেমের বোধন – কলমে – অপরাজিতা , পর্ব ১২


গোটা বাড়ি জুড়ে হৈচৈ, যেখানে যে থাকে সবাই আসে এই সময়। পিসি মাসি, মামা মামী, তাদের ছেলে মেয়েরা, নাতি নাতনিরা বাড়ি ভর্তি লোকজন। বিয়েবাড়ি বললেও অসুবিধা হয়না। অভিদের এত বড় বাড়ি থাকা নিয়েও কোনো অসুবিধা হয়না। রাঁধুনি রান্না করছে, গান বাজছে, উঠোনে প্যান্ডেল হয়েছে, চেয়ারে বসে বসে যে যার মতো আড্ডা দিচ্ছে। পুরো উৎসব উৎসব আমেজ। তবে এবারে অনেকে এখনো আসেনি, সব আসবে অষ্টমীর মধ্যে।

আর একপাশে চলছে সকালের খাওয়া – দাওয়া। মেনু জানে অভি – কেননা প্রত্যেকবার একই মেনু। সকালে লুচি, বেগুন ভাজা, ছোলার ডাল, আলুর দম, বোঁদে, রসগোল্লা। সকালের দিকে রোজই প্রায় একই মেনু হয়, লুচির বদলে কচুরি হতে পারে তার বেশি কিছু না। ষষ্ঠী , সপ্তমী, নবমী, দশমী দিন রাতে মাছ , দশমীর রাত্রে মাছ, ছাগলের মাংস। অষ্টমীতে পুরো নিরামিষ।

একটা সিক্রেট – বাড়ির ছেলেদের এইসবে মন নেই, দুপুরে হালকা করে খেয়ে ঠাকুর দেখার নাম করে বাইরে সাঁটিয়ে মাংস ,ভাত, বিরিয়ানি, চিকেন , মটন খেয়ে আসে। না বাবা কাকা ভালো মানুষ তারা যায় না। ছেলেপিলে, আর ছোট পিসে,ছোট পিসে খাওয়ায়। অবশ্য অনেকে তাদের বরদের ছেলে মেয়ের অকল্যাণের ভয় দেখিয়ে দিব্যি করিয়ে নেওয়ায় তারা যায় না।

অভিদের বাড়ির অদ্ভুত নিয়ম, ষষ্ঠীতে মায়ের বোধন হওয়া থেকে অষ্টমীর খ্যানের পুজো অবধি বাড়ির ছেলে বৌরা একসঙ্গে থাকতে পারবে না। এখনো দাদু ঠাকুমা, বাবা মা, কাকা ছোটমা সবাই আলাদা থাকে। এবারেও ব্যতিক্রম হবে না। শুধু অতিরিক্ত সংযোজন এবারে অভি আর গুঞ্জাও আলাদা থাকবে। কারণ জিজ্ঞাসা করলে আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারেনি কেন? কিন্তু নিয়ম যখন পালন হবেই। এতদিন ধরে এই নিয়মটাকে বেশ লাগলেও এবারে বাড়ির এই নিয়মটাকে অদ্ভুত লাগছে।

অথচ মেয়ে জামাইরা ইচ্ছা করলে একসঙ্গে থাকতে পারবে। যদিও ছোট পিসি বাদে বাকি পিসি, পিসির মেয়েরা একসঙ্গে থাকে। মা, ছোটমা, ছোট পিসি, পিসির ছেলের বৌরা সব একসঙ্গে থাকে। ঠাকুমা নাতনিদের নিয়ে থাকে।মামীমারা , মাসিরা সব একসঙ্গে থাকে। এতে কারুর কোনো অভিযোগ নেই ,তাদেরকে আলাদা ঘরের ব্যাবস্থা করলে তারা থাকবে না। এই যে পি এন পিসির এত বড় সুযোগ কেউ হাতছাড়া করতে রাজি নয়। নিজেদের নিজেদের গ্যাং আছে। সেই পছন্দমতো লোকজন একসঙ্গে থাকে, মজা করে। ছেলেরাও তাই। পিসেরা, মামারা, মেসোরা,বাবা কাকা সব একজায়গাতেই থাকে। একজায়গায় থাকে অভির পিসির ছেলেরা , মাসির ছেলে মেয়ের বর সব, নিজেদের মতো চলে আড্ডা ,গল্প। ছোট পিসের অবশ্য সব জায়গায় অবাধ বিচরণ। তিনি সব দলে ঘুরে নিজের মতো আনন্দ করেন। অভিও নিজেদের গ্রুপেই ভিড়তো তবে এবারে আর সেসবে মন নেই।

 

ঠাকুর তৈরী হয়ে গেছে। মুখখানি ঢাকা আছে এখনো। গুঞ্জা ঠাকুর দালানে বসে বসে মালা গাঁথছে, তার হাত দুটো মালা গাঁথলেও চোখ দুটো সদর দরজার দিকেই। দেরি হবে বলেছে অভি তবুও। ১০ টা বেজে গেছে। আর ১,ঘন্টার মধ্যেই ঢুকবে। কিছুই না, তবুও চোখে দেখবে গুঞ্জা অভিকে, কয়েকদিন ধরে দেখতে পাবে ওকে গুঞ্জা। আচ্ছা সোহিনী রাগ করেছে নিশ্চই? আসতে দিতে চায়নি হয়তো – গুঞ্জা আছে যে, হয়তো অভি জোর করে এসেছে, নাহলে দাদুভাই, বাড়ির লোক ভুল বুঝবে।

অভি —————, কে কোথায় আছো গো দেখো ,ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে। – মজা করে চেঁচালো মেজপিসির বড় ছেলের বৌ, এটা হলো বদলা। প্রতিবারেই ষষ্ঠীর দিন আসে ওরা , সামান্য কলকাতা থেকে আসতেই ১২ টা বাজিয়ে দেয় , অভি পঞ্চমীতেই চলে আসে সেই সুদূর ব্যাঙ্গালুরু থেকে। তাই মজা করে বলে – কে কোথায় আছো গো দেখো, এতক্ষনে ঘরের ছেলে, বৌ ,নাতনি ঘরে ফিরেছে। এবারে একটু আগে এসেছে বলে শোধ নিচ্ছে।

গুঞ্জা আনমনে ঐসব ভাবছিলো। চেঁচানি শুনেই চমকে তাকালো। হাতে সুচ বিধলো। না কেউ দেখেনি – এমন কিছু নয়। অভি দেখে নিয়েছে আগেই যে তার পরিণীতা কোথায়? বাড়ির অন্যরা সব এলো। কে বলছে – বাব্বা এতক্ষনে আসার সময় হলো, কে বলছে -বাড়ির ছেলে সে আগে আসবে তা নয় আমরা সব চলে এলাম।

অনুপমা বললো – চল আগে মাকে প্রণাম কর।

ঠাকুর দালানে উঠে মাকে প্রণাম করলো অভি।

অনুপমা – অনেক দেরি হয়ে গেছে হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নে না তারপর উপরে যাবি? গুঞ্জাও তো খায়নি।গুঞ্জা তুইও খেয়ে নে।

গুঞ্জা – আমি পরে খাচ্ছি। মালাটা গেঁথে নিই।

অভি – আমিও একটু পরে খাবো আগে একটু নুন চিনি লেবুর সরবত দাও। আর দরকার আছে উপরে চলো। গুঞ্জা তুমিও আসবে। ছোটমা কোথায়?

অনুপমা – যা তো মা, সুপ্রিয়াকে বল সরবত করে উপরে আনতে আর তুই উপরে আয়।

অভি , অনুপমা ওদের ঘরে গেলো। সুপ্রিয়াও গেলো, গুঞ্জাই সরবত করছে। অভি প্রত্যেকবার পুজোর সময় মা, ঠাকুমা ,ছোটমার এক ধরণের শাড়ী, রং আলাদা , পিসির লিপস্টিক ( এই বয়সেও সাজগোছ করতে বড় ভালোবাসে ), পিসের সিগারেট, বাবা, কাকুর টি শার্ট, দাদুভাইয়ের জন্য নতুন নতুন বই, জুঁই আর পুচকিটার জন্য তাদের অর্ডার হওয়া জিনিস নিয়ে আসে।

বাড়ি এসে আগেই দিয়ে দেয়। নাহলে রিম্পা দেখলে আমাকে দিলি না, আমার জন্য কিছু আনলি না, এইসব করবে। আজ উপায় নেই ওর আগেই এসে গেছে রিম্পা। যাই হোক সবার সব জিনিস ব্যাগ থেকে বের করলো অভি।

অনুপমা – সুপ্রিয়া প্রায় একসাথেই বললো – মেয়েটার জন্য কিছু আনিস নি?

অভি – তোমাদের মেয়েটা কোথায় ? কাকে দেব?

সুপ্রিয়া – তাই বল , দরজা থেকে বেরিয়ে ফের ঘরে ঢুকে বললো – ওই যে আসছে। দিদিভাই ও ওর বৌকে যা দেবার দিক, আমরা পরে দেখবো। চলো আমরা আমাদের জিনিস নিয়ে যাই, নিচে গিয়ে দেখি কি হচ্ছে।

গুঞ্জা ঘরে ঢুকলো। অনুপমা আর সুপ্রিয়া বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। গুঞ্জা ঘরে ঢুকে অভির হাতে সরবত দিলো।

অভি বললো – বোস।

গুঞ্জা হাতে সরবতের ট্রেটা শক্ত করে ধরে বসলো।

অভি উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।

আর একটু শক্ত হয়ে বসলো গুঞ্জা। কি বলবে ও ? সোহিনীর কথা?

অভি বিছানায় বসলো – বললো – খাওনি কেন?

গুঞ্জা – এমনি

অভি – আমার জন্য ওয়েট করছিলে ?

গুঞ্জা – হ্যাঁ। না এমনি, মালা গাঁথছিলাম।

অভি – মানে আমি যে সেই কাল রাত থেকে উপোস আছি তাতে তোমার কিছু মনে হয়নি?

গুঞ্জা – রাত থেকে?

অভি – না সকাল থেকে খাইনি তোমার কিছু মনে হয়নি।

মজাটা ও সত্যি বোঝে নি। যেন কত অপরাধ করে ফেলেছে এমন ভাব করে গুঞ্জা উঠে পরে বললো – আমি এখুনি খাবার এনে দিচ্ছি।

অভি – বোস। জিজ্ঞাসা করলাম যে কি চাই? কি নিয়ে আসবো? বললে না। এগুলো এনেছি দেখো পছন্দ হয় কিনা ? বলে গুঞ্জার পছন্দ করা শাড়ী গুলোই বের করলো ব্যাগ থেকে।

গুঞ্জা সত্যি চমকে গেছে- এগুলো তো ও প্রিয়া দিকে পছন্দ করে দিয়েছিলো। প্রিয়াদি ওর জন্য পাঠিয়েছে? নাকি অভি বলেছিলো প্রিয়াদিকে ? ঘেটে যাচ্ছে।

অভি চুপচাপ গুঞ্জার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে আর সরবত খাচ্ছে।

এগুলো আমার জন্য ? প্রিয়াদি নেবে ? গুঞ্জর মাথায় কিছুই ঢুকছে না।

অভি – হুম তোমার জন্যই, আমি শাড়ী পড়ি না। আর ইচ্ছাও নেই। তুমি ব্যাঙ্গালুরুতে গেলে নিজের পছন্দ মতো জিন্স, টপ , স্কার্ট, শার্ট, টিশার্ট যা খুশি কিনো। আমার পছন্দ ভালো নয়। সেই জন্যই তো বললাম পছন্দ করতে।

গুঞ্জা – জিন্স, টপ? বললাম মানে ?

অভি – এখনো কিছু বুঝলে না ?

গুঞ্জা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো দরজায় ধাক্কা – অভি অভি, রিম্পা আর টুম্পা ডাকছে।

দরজা খুললো অভি। টুম্পা বললো – বাবা বৌকে ঘরে একলা নিয়ে কি করছিস রে ? দিদিরা এসেছে দেখা করতে শুধু করতে ইচ্ছা করছে না। বিয়ের পর কত উন্নতি হয়েছে রে তোর। ( সে প্রায় রিম্পার জেরক্স কপি)

অভির এখন ঝগড়া করতে ইচ্ছা করছে না। বললো – একটু দরকার ছিল ওর সাথে।

রিম্পা শাড়ী গুলো দেখে কি সুন্দর রে শাড়ীগুলো? কাদের জন্য এনেছিস?

অভি – গুঞ্জার জন্য,

রিম্পা – এতগুলো , বাব্বা, আমাদের জন্য তো কিছু আনিস না কোনো দিন।

অভি – আমি যতদূর জানি এই বাড়ি থেকে পুজোতে তোদের সবাইকে শাড়ী দেয় , এবারে দেয়নি। আর মা বলছিলো তুই আমার বিয়েতে একটা বেনারসি

রিম্পা কথা শেষ করতে না দিয়েই – চল টুম্পা। নিচে যাই। অনেক কাজ আছে। বলে টুম্পাকে টানতে টানতে চলে গেলো। জুঁই, মামিমা ইতিমধ্যে খাবার জন্য ডাকতে এসেছে। না হোয়াটস্যাপ পর্বের খোলসা হলো না। শাড়ী দেখে জুঁই এইগুলো এনেছিস দাদাভাই, বৌমনির জন্য খুব সুন্দর। আমি নিয়ে যাচ্ছি বৌমনি, সবাইকে দেখি আবার দিয়ে যাচ্ছি বলে জুঁই শাড়ীগুলো নিয়ে নিচে গেলো। গুঞ্জা মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন নিয়ে বসে রইলো। অভি গুঞ্জাকে বললো – এই যে খুব খিদে পেয়েছে তো, খেতে গেলে হয়না এবার।

কি রে খেতে যা। ডাকছে তো তোদের। – মামিমা ফের ডাক দিলো।

বেশ খিদে পেয়েছে। অনেকে ঢুকলো। কে কেমন আছে সে সব হওয়ার পর পাশাপাশি খেতে বসলো অভি আর গুঞ্জা। এদিকে খেতে বসলেও গুঞ্জার মাথা থেকে শাড়ী নিয়ে প্রশ্ন যাচ্ছে না।
পাতে বেগুন ভাজা পড়ল মেয়ের হুঁশ নেই।

অভি গুঞ্জাকে একটু কাঁধে করে ঠেলা দিয়ে বেগুন ভাজাটা ওর পাত থেকে নিয়ে নিলো। যে খেতে দিচ্ছিলো সে ফের গুঞ্জাকে আর একটা বেগুন ভাজা দিতে গেলো। অভি বললো – ওকে দিয়ো না। ও খায়না।

গুঞ্জা ফের অবাক , ও কি করে জানলো? প্রিয়াদি ওকে সব বলেছে ? সোহিনীর কথাটাও ? এবার কি হবে ?অভি যদি গুঞ্জাকে কিছু বলে ?

অভি খুব ভালো করে বুঝতে পারছে কি হয়েছে গুঞ্জার ? কিন্তু কিছু বললো না। শুধু বললো – বলছি লুচিগুলো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। একে একে লুচি তরকারি পড়েছে গুঞ্জার সেদিকে মন নেই। শুধু ভেবেই চলেছে।

জুঁই এসে বললো – দাদাভাই দেখ তোর হোয়াটসাপে একটা কিছু পাঠিয়েছি। অভি নিজের আর গুঞ্জার মোবাইল বের করলো।  নিজের হোয়াটসাপে দেখলো জুঁই ওদের দুজনের এখানকার খাওয়ার একটা পিকচার পাঠিয়ে দিয়েছে। এদিকে আর এক দল এলো। অভি কথা বললো। গুঞ্জা তাদের সাথে কথা বলছে। জুঁইও তাদের নিয়ে ব্যাস্ত।

নানা কথা চিন্তা করতে করতেই  কোনো রকমে খাওয়া শেষ করলো গুঞ্জা। অভি আস্তে আস্তে বললো- খেয়ে উপরে ঘরে যাও, আমি আসছি দরকার আছে। না গেলে, যেখানে দেখতে পাবো হাত ধরে টেনে নিয়ে যাবো। এই অভিকে গুঞ্জা চেনে না। একটা বিরক্ত, রাগী অভিকে চেনে। কিন্তু তবে কি সোহিনীর সাথে সব সম্পর্ক চুকিয়ে গুঞ্জার কাছে ফিরে এসেছে অভি? নাকি সেদিন প্রিয়াদি সত্যিই বলেছিলো সোহিনী শুধু ওর বন্ধু। তাহলে রিম্পা দি মিথ্যা বলেছিলো? সোহিনী রাগ করেছিল কেন? কি সত্যি সত্যি?উপরে গেলো গুঞ্জা।

গুঞ্জাকে জানতেই হবে প্রিয়াদি কেন এমন করলো ? কেন সব বলে দিলো অভিকে?

গুঞ্জা ঘরে ঢুকে নিজের মোবাইল খুলে দেখলো – প্রিয়াদির ডি পি তে আজকের অভি গুঞ্জার খওয়ার ছবি, আর সঙ্গে নতুন ম্যাসেজ – এখন কি আমাকে চেনা গেছে ? রসগোল্লা গুলো খুব ভালো ছিল খেতে পারতে। যাই হোক ঘরে ওয়েট করো আমি আসছি। নাহলে সত্যি যেখানে দেখতে পাবো হাত ধরে ঘরে নিয়ে যাবো।

হুম অনলাইন দেখেই ম্যাসেজ করেছিল অভি। ব্যাস ম্যাডাম দেখেছেন। আচ্ছা দেখে আবার কাঁদতে বসবে না তো ?তাড়াতাড়ি উপরে ঘরে যেতে হবে। ……………………………..

 

আগের পর্ব – অকালে প্রেমের বোধন – কলমে – অপরাজিতা , পর্ব ১১

 

পরের পর্ব –অকালে প্রেমের বোধন – কলমে – অপরাজিতা , পর্ব ১৩

আপনার মতামত জানান -

Top
error: Content is protected !!